ধূমপানের ক্ষতি লিখে শেষ করা যাবে না। ‘ধূমপান’ শব্দটি ‘ধূম’ এবং ‘পান’ শব্দদ্বয়ের একত্রে গঠিত। ধূম হলো ‘ধোঁয়া’ বা বাষ্পের প্রতিশব্দ। যেহেতু ধূমপান তামাকজাতীয় পদার্থের ধোঁয়া গ্রহণ করা হয় বা পান করা হয়, তাই একে ‘ধোঁয়া পান’ করা হিসেবে বলা হয়, সে হিসেবে ধূমপান শব্দটি গঠিত হয়েছে। আমরা সিগারেট, চুরুট এবং পাইপের মাধ্যমে জ্বলন্ত ধোঁয়া নিঃশ্বাসের সাথে টেনে নেওয়া এবং তা বের করে দেওয়ার প্রক্রিয়াকেই সাধারণত ধূমপান বলা হয়।

ধূমপান একটি মারাত্মক ক্ষতিকর ও বদ অভ্যাস। ইংরেজিতে একটা কথা আছে “Smoking is injurious to health it causes cancer” আর বাংলায়  ‘সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’। ধূমপান যে ক্ষতি সে সম্পর্কে জানে না এমন কোন লোক নেই । তারপরও অধিকাংশ ধূমপায়ী ধূমপান করে চলছে। অতচ্ছ এর মারাত্মক ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে জানে না।

ধূমপান ছাড়ার পদ্ধতি
ধূমপান ছাড়ার পদ্ধতি

ধূমপানের অপকারিতা: এক গবেষণায় জানা গেছে সিগারেটের ধূমপানে নিকোটিনসহ ৫৬টি বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ বিরাজমান। এর আগে ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে পরিচালিত এক গবেষণায় বলা হয়েছিল যে, অন্যের ধূমপানের (পরোক্ষ ধূমপান) শিকার হওয়া ব্যক্তিদের ৪০% শিশু, ৩৩% অধূমপায়ী পুরুষ এবং ৩৫% অধূমপায়ী নারী রয়েছেন। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে বিশ্বের ১৯২টি দেশে পরিচালিত একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিজে ধূমপান না করলেও পরোক্ষ ধূমপানের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর প্রায় মানুষ মারা যায় ৬,০০,০০০ জন। এর মধ্যে শিশুর সংখ্যা ১,৬৫,০০০। শিশুরা পরোক্ষ ধূমপানের কারণে অ্যাজমায় ও নিউমোনিয়া আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর দিকে ঝুঁকে পড়ে।

এছাড়া পরোক্ষ ধূমপানের কারণে হৃদরোগ, ফুসফুসের ক্যান্সার সহ শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত রোগও দেখা দেয়। গবেষণায় আরো বলা হয়েছে যে, পরোক্ষ ধূমপান পুরুষের তুলনায় নারীর উপর বেশি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। পরোক্ষ ধূমপানের কারণে বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৮১,০০০ নারী মৃত্যুবরণ করেন। অন্য আরেক গবেষণায় বলা হয়েছে, পরোক্ষ ধূমপানের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির স্বীকার হচ্ছেন ইউরোপ ও এশিয়ার (বাংলাদেশ) মানুষ।

আপনি আরও পড়তে পারেন : করোনাভাইরাস থেকে মুক্তির প্রাকৃতিক উপায়

ধূমপানের ক্ষতিকর দিকগুলো:

এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা একবার কৌতূহল বশত একটি সিগারেট পান করেছে তাদের অনেকেই পরবর্তীতে পুরাদস্তুর ধূমপায়ী হয়ে গেছেন। ধূমপান যে কত প্রকার ক্ষতি তা বলে শেষ করা যাবে না। নিম্নে কিছু ধূমপানের ক্ষতিকর দিক সমূহ তুলে ধরা হল।

১. নেশাগ্রস্থ করে: সিগারেটের ধোঁয়াতে যে নিকোটিন থাকে তা হিরোইন অপেক্ষা শক্তিশালী। যা একজন সুস্থ ব্যাক্তিকে নেশাগ্রস্থ করে তুলে।

২. অপমৃত্যু ঘটায়: ধুমপান মানুষের অপমৃত্যু ঘটায়। আন্তর্জাতিক স্বাস্হ সংস্হা তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করেন যে, সমগ্র পৃথীবিতে ধুমপানের কারনে যত বেশি অপমৃত্যুর ঘটন ঘটে অন্য কোন রোগ-ব্যধির কারনে তত বেশি অপমৃত্যু ঘটেনা। এর জন্য বিশ্বে প্রতি বছর মারা যায় প্রায় ৩৫ লক্ষ মানুষ। ১৯৫০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত শুধু উন্নয়নশীল দেশগুলোতেই মারা গেছে প্রায় ছয় কোটি লোক। আর এদের অর্ধেকই ছিল যুবক শ্রেণী।

৩. রোগপ্রতিরোধ কমায় : ধূমপানে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। ধুমপানের কারনে ফুসফুসে ক্যান্সার, শরীরে তাপ, প্রদাহ, জ্বালাপোড়া ইত্যাদি দীর্ঘ মেয়াদী রোগব্যাধী দেখা যায়। ধুমপানের কারনে ফুসফুসে ক্যান্সার, শরীরে তাপ, প্রদাহ, জ্বালাপোড়া ইত্যাদি দীর্ঘ মেয়াদী রোগব্যাধী দেখা যায়।

৪. গৃহ হারা: ধূমপানকারী পরিবার, দেশে ও সমাজে সর্বমহলে একজন ঘৃণিত ব্যক্তি হিসাবেই বিবেচিত হয়। ধূমপানকারী পরিবার থেকে ধীরে ধীরে দূরে রাখে।

৫. অপচয়: ধূমপান নিঃসন্দেহে একটি অপচয়। আর আল্লাহ তা‘আলা অপচয় সম্পর্কে বলেন, وَلاَ تُبَذِّرْ تَبْذِيْراً، إِنَّ الْمُبَذِّرِيْنَ كَانُوا إِخْوَانَ الشَّيَاطِيْنِ ‘তোমরা অপচয় করো না। অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই’ (ইসরা ২৬, ২৭)। মহান আল্লাহ অপচয়কারীদের অপছন্দ করে।

৬. শ্রবণশক্তি কময় : একজন ধূমপায়ীর শ্রবণশক্তি কম থাকে। সম্প্রতি উইনকনসিন বিশ্ববিদ্যালয় ৩৭৫০ জন লোকের উপর এক সমীক্ষা চালায়। সেখানে লক্ষ্য করা যায় যে, অধূমপায়ীদের চেয়ে ধূমপায়ীদের শ্রবণশক্তি কমার সম্ভাবনা শতকরা ৭০ ভাগ বেশী। এক গবেষকরা বলা হয়েছে যে, একজন ধূমপায়ীর ধূমপানকালীন সময়ে কোন অধূমপায়ী উপস্থিত থাকলে তারও একই সমস্যা দেখা দেবে।

৬. কন্ঠনালীতে ক্যান্সার: ধূমপান সরাসরি গলায় আক্রমণ করে। এজন্য কন্ঠনালীতে ক্ষতি হয়।  ধুমপানের কারনে কন্ঠনালীতে ক্যান্সার হয়ে থাকে।

৭. রক্তনালীগুলো দুর্বল করে : ধূমপানের কারণে রক্ত নষ্ট হয়ে যায়। এর কারনে রক্তনালীগুলো দুর্বল হয় এবং অনেক সময় একজন ধুমপায়ীর রক্তের চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ধূমপান উচ্চ রক্ত চাপের কারণ হয়।

৮. আদর্শহীন ব্যক্তিতে পরিণত: একজন ধূমপায়ী দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে ব্যার্থ হয়। ধূমপায়ীরা ছেলে-সন্তান এবং উত্তরসূরীদের জন্য একজন আদর্শহীন ব্যক্তিতে পরিণত হয়।

৯. রনশক্তি কমিয়ে দেয়: একজন ধূমপায়ী লক্ষে এগিয়ে যেতে পারে না কারণ এটি স্মরনশক্তি কমিয়ে দেয় এবং মনোবল দুর্বল করে দেয়।

১০. ইন্দ্রিয় ক্ষমতা দুর্বল করে: ধূমপানের আরেকটি বড় সমস্যা হলো ইন্দ্রিয় ক্ষমতা দুর্বল করে; বিশেষ করে ঘ্রান নেয়া এবং স্বাদ গ্রহনের ক্ষমতা লোপ পায়।

১১. ক্যান্সার হয় :  ধূমপানকারীর ফুসফুস, মুত্রথলি, ঠোঁট, মুখ, জিহবা ও কণ্ঠনালি, কিডনী ইত্যাদিতে ক্যান্সার হয়।

১২. দৃষ্টিশক্তি লোপ পায়: অতিরিক্ত ধুমপানের কারনে দৃষ্টিশক্তি লোপ পায়।

১৩. হার্টের সমস্যা বাড়ায় : হার্টের সাথে সম্পৃক্ত ধমনিগুলো ব্ল¬¬ক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল হয়। এমনকি বক্ষ ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

১৪. খারাপ লোক হতে সহায়তা :  ধুমপান মানুষকে খারাপ মানুষের সাথে উঠা বসায় বাধ্য করে। ধীরে ধীরে সে খারাপ পথে চলে যায়। সমাজ বিরোধী কাজে লিপ্ত হয়।

১৫. পেটের সমস্যা বৃদ্ধি: ধূমপানের ফলে হজমশক্তি কমে যায়, ধারণক্ষমতা লোপ পায় এবং শরীর ঢিলে হয়ে যায়। ধূমপানের ফলে পাকস্থলী ক্ষত হ’তে থাকে এবং যকৃৎ শুকিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

১৬. মুত্রনালীতে বাধা : ধূমপানের ফলে মুত্রথলি যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয় এবং প্রস্রাব বিষাক্ত হয়।

১৭. যৌনশক্তি বিলুপ্ত করে : ধুমপানের কারনে যকৃত শুকিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ধূমপানের ফলে যৌনশক্তি বিলুপ্ত হ’তে থাকে।

১৮. জ্ঞান-বুদ্ধি লোপ: ধূমপান মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি লোপ করে দেয় । কারণ সে ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর জেনেও সে তা পান করে। ধূমপায়ী সব সময় দুর্বলতা অনুভব করে এবং আতঙ্কগ্রস্ত থাকে।

ধূমপান ছাড়বেন কিভাবে ?

নিয়মিত ধূমপান যারা করেন তাদের জন্য ছাড়া একটু কষ্ট সাধ্য। বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষুদ্রতম স্বার্থকে ত্যাগ করাকে সুযোগ ব্যায় বলে। ধূমপানের ক্ষতি থেকে প্রধানত বাঁচতে হবে। কিছু চিকিৎসকের দৃষ্টিতে ধূমপান ছাড়ার কয়েকটি সহজ উপায় সমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো।

১. আজ থেকে মনে করুন বা বলুন আমি সিগারেট কি তা জানি না। এটাকে চিনিও না আর এটা কি করে তাও জানি না। সোজা কোথায় , আমি চিনি না।

২. একদিন ধূমপান না করলে কি হবে। এরপর দিন পার্থক্য অনুভব করার চেষ্টা করুন। এরপর দুইদিন, তিনদিন ধূমপান থেকে দূরে থাকুন। তাহলে অভ্যাস গড়ে উঠবে।

৩. আপনার আশপাশে যারা ধূমপান বর্জন করেছে তাদের কে দেখুন। তাদের স্বাস্থ্যগত কী পরিবর্তন এসেছে সেটি জানার চেষ্টা করুন।

৪. একটু হিসেবে করে দেখুন আপনার কত টাকা খরচ হয়েছে সিগারেট কিংবা তামাকজাত পণ্যের জন্য ? হিসেব করে দেখলে বুজবেন ধূমপান ছাড়া আপনার জন্য কতটা জরুরি। এই হিসাবি আপাকে ধূমপান ছাড়তে সাহায্য করবে খুব সহজে।

৫. আপনার যেসকল বন্দুরা ধূমপান করে তাদের থেকে সুকৌশলে এড়িয়ে চলুন।

৬. সিগারেট ছাড়ার পর মুখে চুইংগাম, গোলমরিচ, দারুচিনি কিংবা আদা চিবোতে পারেন। এতে ধূমপানের প্রতি আকর্ষণ কমে আসবে।

৭. যখন আপনার ধূমপান করতে ইচ্ছা করবে তখন একটু রাস্তায় হাঁটুন। তাহলে ধূমপানের চাহিদা থাকবে না।

৮. যে কোন জায়গায় ধূমপান কর্নার থেকে দূরে থাকুন অর্থাৎ ধুমপান মুক্ত জায়গায় থাকুন।

৯. ধূমপান বিরোধী এবং স্বাস্থ্য সচেতনতার বই পড়তে পারেন অথবা ভিডিও দেখতে পারেন।

১০. নিরুপায় হলে সর্বশেষ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে কাউন্সেলিং-এর সহায়তা নিতে পারেন।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ বলছেন, ধূমপান ছাড়ার জন্য কোন প্রস্তুতির দরকার নেই। আপনার একটি সিদ্ধান্তই যথেষ্ট হতে পারে। আমি মনে করি এই পোস্টি দেখার পর অনেক দুমপায়ীদের উপকারে আসবে। পোস্টি ভালো লাগলে শেয়ার করে আপনার বন্ধুদের সহায়তা করতে পারেন। আর আপনার মন্তব্যটি কমেন্টে জানাতে পারেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *