ডায়াবেটিস শুনলে মনের মধ্যে আতঙ্ক চলে আসে৷ বর্তমানে সারা দেশে বহু মানুষ এই রোগে আক্রান্ত। তবে বেশ কিছু মুক্তির জন্য প্রাকৃতিক ও বিকল্প উপায় রয়েছে ৷ সেই সাথে সঠিক চিকিৎসা ও ভেষজ খাদ্যাভাসও একান্ত প্রয়োজন৷
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীতে বর্তমানে ৪২ কোটিরও বেশি মানুষের ডায়াবেটিস আছে আর ২০৪০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা বেড়ে হবে ৬৪ কোটিরও বেশি। আমাদের বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে (২০১১) অনুসারে বাংলাদেশে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের হার মোট জনগোষ্ঠীর শতকরা ১১ ভাগেরও বেশি।
ডায়াবেটিসের ধরণ:- ডায়াবেটিস সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে। ডায়াবেটিস টাইপ ১ ও টাইপ ২ । টাইপ ১ ডায়াবেটিস ধরা পড়ে শৈশবেই। এক্ষেত্রে শরীরে ইনসুলিন তৈরির পরিমাণ কমে যায়।
টাইপ ১ ডায়াবেটিস সাধারণ লক্ষণগুলি হল, আক্রান্ত ব্যক্তির ঘন ঘন প্রস্রাব পায়, গলা শুকিয়ে যায় বার বার, ওজন কমে যায়আর শরীর দুর্বল লাগে।
আর টাইপ ২ ডায়াবেটিস সবচেয়ে বেশি আমাদের চোখে পড়ে। এটি সাধারণত মধ্য ও বৃদ্ধদের দেখা দেয় তবে বর্তমান তরুণ বয়সেই আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকে। টাইপ ২ ডায়াবেটিস রোগীর শরীরে তৈরি ইনসুলিন ঠিকমত কাজ করতে পারে না।
এছাড়াও তৃতীয় অন্য আরেকটি ডায়াবেটিস দেখা যায়, সেটা হল গর্ভাবস্থার ডায়াবেটিস। গর্ভাবস্থায় মায়ের শরীরে গ্লুকোজের পরিমাণ নিয়মিত মাপা খুব জরুরী। সাধারণত সন্তান জন্মের পরে মা সুস্থ হয়ে যায়, তারপরেও মায়ের ঝুঁকি রয়ে যায় টাইপ ২ ডায়াবেটিসের।
আমরা ইতিমধ্যেই জানতে পেরেছি , ডায়াবেটিস হলো একটি বিপাকীয় প্রক্রিয়া সংশ্লিষ্ট রোগ। যার কারণে দেহ যথেষ্ট পরিমাণে ইনসুলিন উৎপাদনে অক্ষম হয়ে পড়ে বা ইনসুলিন প্রত্যাখ্যান করে। ফলে আমাদের রক্তে সুগারের মাত্রা বেড়ে যায় অস্বাভাবিক হারে। রক্তে সুগারের মাত্রা খুব বেশি বেড়ে গেলে ঘন ঘন প্রস্রাব, ক্লান্তি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া ক্ষত শুকাতে দেরি হওয়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়।
ডায়াবেটিসের সবচেয়ে ভয়ানক বিষয়টি হলো এই রোগ কখনো পুরোপুরি ভালো হয় না। তবে ভয় পাওয়ার কারণ নেই। ডায়াবেটিসের লক্ষণগুলো দূর করে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে কিছু নিয়মাবলীঃ
১। প্রতিদিন ফল ও সবুজ সবজি খান৷ যে কোন ধরণের মিষ্টি খাবার এড়িয়ে চলুন৷
২। সর ছাড়া দুধ ও কুসুম ছাড়া ডিম খান৷
৩। ফাইবার জাতীয় খাবার তালিকায় রাখুন৷
৪। নিয়মিত দিনে ২বার আপেলের রস খান৷
৫। রুটিন করে খাবার খান৷ অতিরিক্ত খাবার খাবেন না৷
৬। তেল থেকে দূরে তখুন। খেলে তা খুব অল্প পরিমাণে খাবেন৷
৭। সারাদিনে প্রচুর পরিমাণে পানি পান করুন। এটি আপনার শরীর থেকে টক্সিন জাতীয় উপাদান বের করতে সাহায্য করে৷
এছাড়াও ডায়াবেটিস রুখতে বেশ কিছু ভেষজ প্রতিকারও রয়েছে৷ জেনে নিন সেই সব প্রতিকার সম্পর্কে-
ডায়াবেটিস থেকে মুক্তির প্রাকৃতিক উপায় :-
১# ডায়াবেটিস রোধে জাম – ডায়াবেটিস রোধে জাম খুব উপকারি৷ এটি শর্করাকে শ্বেতসারে রূপান্তরিত হতে বাধা দেয়৷
২# ডায়াবেটিস রোধে রসুন- রসুনের উপকারিতা বলে শেষ করা যাবে না। রসুন এই রোগেরই একটি অন্যতম ভেষজ প্রতিকার৷ রসুনে অ্যালিসিন থাকে যা রক্তে শর্করার পরিমাণ বাড়তে দেয়না৷
৩# ডায়াবেটিস রোধে কারি পাতা- প্রতিদিন সকালে যদি ৫ থেকে ১০টি তাজা কারি পাতা খাওয়া যায় তবে ডায়াবেটিস থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব৷
৪# ডায়াবেটিস রোধে আমের পাতা – টাটকা আমের পাতাকে একগ্লাস জলে সেদ্ধ করে সারারাত রেখে দিন৷ পরদিন সকালে পাতা ছেঁকে যদি সেই জল খেলে তবে ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভবনা থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে৷
আপনি যদি ডায়াবেটিস থেকে দূরে থাকতে চান তাহলে আপনার জন্য রয়েছে কিছু পরামর্শ। আপনি যদি এই পরামর্শগুলো নিয়মিত পালন করেন তবে আপনার ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা ০.০১% এর কম থাকবে। নিম্নে আমাদের পরামর্শ দেওয়া হলো :
ডায়াবেটিস থেকে নিরাময়ের পরামর্শ সমূহ :
মানসিক চাপ থেকে মুক্ত থাকুন – অতিরিক্ত মানসিক চাপ নিলে ক্যান্সারের মতো ভয়ানক রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে মেডিটেশন ও যোগ ব্যায়াম করতে পারেন। এতে আপনার দেহে কর্টিসোল হরমোনের মাত্রাও নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমে যাবে।
স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখা – স্বাস্থ্যকর ওজন নিয়ন্ত্রণে ডায়াবেটিস সহ অনান্য রোগসমূহ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে আপনার ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ৭০% কমে আসবে।
সালাদ খান – প্রতিদিন দুপুর বা রাতে খাবার খাওয়ার আগে গাজর, শসা, লেটুস, টমেটো, পেঁয়াজ, রসুন ইত্যাদি খেতে হবে। সালাদে রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে। তাই ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও কমে যায়।
প্রচুর হাঁটাহাঁটি করুন – নিয়মিত ৩০ -৪০ মিনিট হাঁটাহাঁটি করুন। এতে আপনার দেহে ইনসুলিনের মাত্রাকেও ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় রাখতে সহায়তা করবে। যার ফলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও কমে যাবে।
দারুচিনি খান – এক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, দারুচিনির আছে অস্বাস্থ্যকর কোলেস্টেরল এবং ট্রাইগ্লিসারাইড এর মাত্রা কমিয়ে আনার প্রাকৃতিক সক্ষমতা। দারুচিনি খেলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমে আসে ৪৮%!
ধুমপান ত্যাগ করুন – ধূমপানের কারণে ফুসফুস ক্যান্সার এর মতো ভয়ঙ্কর রোগের পাশাপাশি ডায়াবেটিসেরও হয়ে থাকে । অতএব ডায়াবেটিসে থেকে বাঁচতে চাইলে আজই ধুমপান ছেড়ে দিন।
পূর্ণ শস্যজাতীয় খাদ্য খান – দিনের শুরুতে পূর্ণ শস্য জাতীয় খাদ্য ব্রাউন রাইস, ওটমিল, বার্লি, ভুট্টা, বাজরা ইত্যাদি খান। পূর্ণ শস্য জাতীয় খাদ্যে আছে প্রচুর পরিমান আঁশ, যা রক্তে সুগারের মাত্রা কমাতে সহায়ক। যার ফলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও কমে।
কফি পান করুন – কফিতে আছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান। এক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, প্রতিদিন অন্তত দুই কাপ কফি পান করলে টাইপ টু ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমে যায় ২৯%। ডায়াবেটিস রোগীদের চিনি ছাড়া কফি পান করতে হবে। আর যাদের ডায়বেটিস নেই তারা অল্প পরিমান চিনি দিতে পারেন। তবে চিনি না খাওয়াই উত্তম।
ফাস্টফুড এড়িয়ে চলুন – ফ্রাইস, পিজ্জা, বার্গার এর মতো ফাস্ট এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার খেলে স্থুলতা, উচ্চ কোলেস্টেরল, হজমে সমস্যা এবং হৃদরোগের মতো নানা রোগ দেখা দিতে পারে। ফাস্টফুড খেলে ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়।