আমাদের দেশের সকলের কাছে খুব পরিচিত একটি ভেষজ গুণসম্পন্ন উদ্ভিদ হলো থানকুনি পাতা। আজকে থানকুনি পাতা খাওয়ার উপকারিতা ও ব্যবহারবিধি, গুণাগুণ আলোচনা করা হবে। কিন্তু এর আগে বিশেষ কিছু জেনে নেই।

এই উদ্ভিদের ল্যাটিন নাম centella aciatica; ইংরেজি নাম Indian pennywort. তবে এই থানকুনি কে অঞ্চলভেদে বিভিন্ন নামে ডাকে যেমনঃ আদামনি, তিতুরা, থানকুনি, টেয়া, মানকি আদাগুনগুনি, ঢোলামানি, থুলকুড়ি, ধূলা বেগুন, মানামানি,  এই সব নামে ডাকা হয়। তবে বেশির ভাগ মানুষের কাছে থানকুনি নামেই সবাই পরিচিত।

থানকুনি পাতা খাওয়ার উপকারিতা
থানকুনি পাতার ছবি

এই থানকুনি পাতা গ্রামাঞ্চলে অনেক আগে থেকেই ব্যবহার হয়ে আসছে। এই থানকুনির পাতা দেখতে ছোট্ট কিন্তু প্রায় গোলাকৃতি, তবে এই ছোট্ট  গোলাকৃতি, এই পাতার মধ্যে রয়েছে ঔষুধি সব গুনাগুন। এই প্রকৃতিক ভেষজ পাতার রস রোগ নিরাময়ে অতুলনীয় কার্যকারিতা ভূমিকা রাখে। এই থানকুনি প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে অনেক রোগের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়। থানকুনির ভেষজ গুণ থেকে, খাদ্য উপায়ে সরাসরি গ্রহণ করে রোগ নিরাময়ে থানকুনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

থানকুনি পাতা খাওয়ার উপকারিতা

এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, কেউ যদি নিয়মিত থানকুনি পাতা খাওয়া শুরু করে। এর ফলে তার সব ধরনের রোগ থেকে রেহাই পাবে। উদাহরণ স্বরুপ – মাথার চুল থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত শরীরের প্রত্যেকটা অংশ কার্যক্ষতা বাড়তে শুরু করবে। একই সাথে পাওয়া যায় আরও অনেক ধরনের উপকার। চলুন তাহলে যেনে নেয়া যাক সেই সব উপকারগুলো কি, কি?

গ্যাস্ট্রিক ভালো হয়:

অনেক সময়ে দেখা যায় যে অসময়ে খাওয়ার কারণে ফেঁসেছেন গ্যাস্ট্রিকের কাছে। এই সমস্যা থেকে রেহাই পেতে আপনি কি করবেন?। তাহলে থানকুনি পাতা কিনে আনুন বাজার থেকে তারপর দেখবেন সমস্যা একেবারে হাতের মধ্যে চলে আসবে আপনার। এর পর আপনি হাফ লিটার দুধে ২৫০ গ্রাম মিশ্রি ও সামান্য পরিমাণে থানকুনি পাতার রস মিশিয়ে একটা মিশ্রন তৈরি করে রাখুন। এরপর সেই মিশ্রন থেকে অল্প অল্প করে নিয়ে প্রতিদিন সকালে খাওয়া শুরু করে দিবেন। দেখবেন এক সপ্তাহ খেলেই উপকার হয়েছে।

টক্সিক উপাদান শরীর থেকে নিঃসরণ করে:

মানুষের শরীরে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর সারা দিন ধরে একাধিক টক্সিন উপাদান, নানাভাবে রক্তে প্রবেশ করে থাকে। যদি সেই ক্ষতিকর টক্সিন বিষেদের, কিন্তু সময় থাকতে শরীর থেকে বের করে না দেওয়া হয়। তাহলে সেই ক্ষেত্রে আপনার কিন্তু বিপদ ঘটবে। এই টক্সিক উপাদান শরীর থেকে নিঃসরণ করার কাজটি করে থাকে থানকুনি পাতা। যেভাবে করে থাকে? আপনার শরীর থেকে টক্সিক নিঃসরণ করতে, আপনাকে যা করতে হবে তাহলো প্রতিদিন সকালে অল্প পরিমাণ থানকুনি পাতার রসের সাথে, ১ চামচ মধু মিশিয়ে নিয়মিত খেলে রক্তে উপস্থিত ক্ষতিকর টক্সিক উপাদানগুলি বের হয়ে যাবে। এই ভাবে নিয়মিত খেলে অনেক রোগ থেকে  সেফা পাওয়া যাবে।

ক্ষত নিরাময় করে:

এই থানকুনি পাতা শরীরে উপস্থিত স্পেয়োনিনস ও অন্যান্য উপকারি উপাদানর ক্ষেত্রে বিশেষ কার্যকারিতা রয়েছে। স্পেয়োনিনস ও অন্যান্য উপকারি উপাদান থাকার কারনে, কোথাও কেটে গেলে সাথে সাথে সেখানে অল্প করে থানকুনি পাতা বেঁটে প্রলোব দিলে নিমেষে কষ্ট কমে যাবে।

হজম ক্ষমতা বৃদ্ধি করে:

আমাদের প্রায় হজমের সমস্যা দেখা দেয়। কিন্তু এই থানকুনি পাতা হজম ক্ষমতার বৃদ্ধি করে। সুতরাং একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে থানকুনি পাতায় উপস্থিত রয়েছে, একাধিক কার্যকারি উপাদান হজমে সহায়ক হিসাবে বিভিন্ন ভাবে কাজ করে। একই সাথে অ্যাসিডের ক্ষরণ যাতে ঠিক মতো হয়, এই থানকুনি পাতা সেদিকে খেয়াল রাখে বিশেষভাবে। এর ফলে গ্যাস-অম্বল ও বদ-হজম মতো এই ধরনের সমস্যা মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না।

ত্বকের সৌন্দর্য বাড়ায়:

এই থানকুনি পাতায় বিভিন্ন ধরনের উপাদান  উপস্থিত থাকে যেমনঃ বিটা অ্যামাইনো অ্যাসিড, ক্যারোটিন, ফ্য়াটি অ্যাসিড ও ফাইটোকেমিকাল। এই সব উপাদান ত্বকের ভিতরে পুষ্টির ঘাটতি পূরণ করার পাশাপাশি বলিরেখা কমাতে বিশেষ গুরুত্ব পালন করে। এর ফলে স্বাভাবিক ভাবেই ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পায়। তার সাথে কম বয়সে ত্বকের বুড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কমতে থাকে।

আমাশা সমস্যা দূর করে:

এই রোগের এক্ষেত্রে প্রতিদিন সকালে খালি পেটে নিয়মিত করে থানকুনি পাতা খাবেন। এমন কি টানা ৭ দিন যদি খেতে পারেন। তাহলে আপনার এই রোগ ইনশাল্লাহ ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু এই ধরনের সমস্যা কমাতে আপনি আরেক ভাবে থানকুনি পাতা কে ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু প্রথমে আপনাকে পরিমাণ মতো থানকুনি পাতা বেটে নিতে হবে। তারপর সেই রসের সাথে অল্প করে চিনি মিশিয়ে সেই মিশ্রনটি দু চামচ করে প্রতিদিন দিনে দুবার খেলেই দেখবেন ভালো হয়ে গেছেন।

চুল পড়া বন্ধ করে:

প্রায় মানুষের চুল পড়ে আর এই চুল পড়া একটি বিশেষ রোগ। কিন্তু এই চুল পড়া নিয়ে নানা সময়ে বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে, সপ্তাহে ২-৩ বার থানকুনি পাতা খেলে চুলের স্কাল্পের ভেতরে যে পুষ্টির অভাব হয় তা দূর করে থাকে। যার ফলে চুল পড়ার মাত্রা কমতে শুরু করে। চুল পড়ার হার কমাতে অন্যভাবে ভাবেও থানকুনি পাতাকে ব্যবহার করা যেতে পারে।

পরিমাণ মতো থানকুনি পাতা নিয়ে তা থেঁতো করে নিন। এর সঙ্গে সম পরিমাণ মতো তুলসি পাতা ও কিছু আমলা মিশিয়ে একটা পেস্ট বানিয়ে। এর সবশেষে পেস্টটা চুলে লাগিয়ে নিয়ে কিছু সময় অপেক্ষা করবেন। তার পর ১০ মিনিট পরে ভালো করে ধুয়ে ফেলুন। এইভাবে সপ্তাহে কম করে ২ বার চুলের পরিচর্যা করলেই দেখবেন আপনার চুলপড়া বন্ধ হবে।

আরও পড়ুন: প্রাকৃতিক নিয়মে চুল পড়া বন্ধ করার উপায়

পেটের রোগের কাজ করে:

এই রোগের জন্য আপনি যা করবেন তা হলো, সামান্য পরিমাণ আম গাছের ছালের সাথে ১ টা আনারসের পাতা এবং হলুদের রস ও সমপরিমাণ মতো থানকুনি পাতা ভাল করে মিশিয়ে ভাল করে বেটে নিতে হবে। তারপর মিশ্রনটি নিয়মিত খেলে অল্প দিনেই যে কোন ধরনের পেটের অসুখ নিরাময় হবে। এর সাথে ক্রিমির প্রকোপ কমে যাবে।

কাশি কমে যায়:

বিভিন্ন সময়ে দেখা যায় যে হাঠাত করে কাশি শুরু হয়। সেই সময় এই থানকুনি পাতার রস ২ চামচ সাথে অল্প করে চিনি মিশিয়ে খেলে সাথে সাথে কাশি নিরাময় হয়। তবে আপনি যদি এক সপ্তাহ খেতে পারেন তাহলে তো  আর কথাই থাকে না। এক্ষেত্রে কাশির কোন প্রকার থাকবে না।

জ্বর কমাবে:

প্রায় মানুষের দেখা যায় যে সিজন পরিবর্তনের সময় যারা প্রায়শই জ্বরের ধাক্কায় কাবু হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে তাদের থানকুনি পাতা খাওয়া জরুলী। সুতরাং আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে উল্লেখ রয়েছে যে জ্বরের সময় ১ চামচ থানকুনি ও ১ চামচ শিউলি পাতার রস মিশিয়ে সকালে খালি পেটে খেলে দ্রুত্ব সময়ের মধ্যে জ্বর ভালো হয়ে যাবে। তার সাথে শারীরিক দুর্বলতা নির্মূল হবে।

থানকুনি পাতা কোথায় পাওয়া যায়

থানকুনি পাতা কয়েকটি দেশে পাওয়া যায়। তার মধ্যে ভারত, বাংলাদেশ, সিংহল, উত্তর অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ইরান, পাপুয়া নিউ গিনি, এবং এশিয়ার অন্যান্য যায়গায় এই উদ্ভিদ এর দেখা পাওয়া যায়। তবে এই ভেষজ উদ্ভিদের এর বহুল ব্যবহার আছে। আয়ুর্বেদিকে এই ভেষজের ব্যবহার বেশি যে দেশ গুলোতে হয়। প্রাচীন আফ্রিকীয়, চৈনিকসহ অনেক দেশের চিকিৎসাবিদ্যায় ব্যবহিত হয়। কিন্তু এর বৈজ্ঞানিক নাম আগে ছিল Hydrocotyle asiatica L. এবং পরে Trisanthus cochinchinensis (Lour) হয়।

থানকুনি পাতা বিশেষ কিছু খাবার তৈরি

থানকুনি পাতার বড়া

থানকুনি পাতার বড়া বানিয়ে খেতে পারেন। তবে কিভাবে বানাবেন এই বড়া তৈরি করতে আপনার প্রয়োজন পড়বে ১০-১২ টা থানকুনি পাতা এবং ২-৩ টে কাঁচা মরিচ ১ টা পেঁয়াজ। তবে এর স্বাদ অনুসারে লবণ লাগবে, আরো লাগবে এক চিমটে হলুদ গুঁড়ো, সামান্য মরিচের গুঁড়ো ও ৩ চামচ বেসন আর লাগব পরিমাণ মতো তেল। আপনাকে করতে হবে প্রথমে পাতাগুলি ভাল করে ধুয়ে নিয়ে ছোট-ছোট টুকরো করতে হবে।

তারপর একটা বাটিতে থানকুনি পাতা মেখে ফেলতে হবে। এর একটা প্যানে পরিমাণমতো তেল নিয়ে একটু গরম করে নিতে হবে। যখন তেলটা গরম হওয়া মাত্র সেই বেসনের মিশ্রণ থেকে অল্প করে নিয়ে তেলের মধ্যে ছেড়ে দিবেন। লক্ষ্য রাখবেন যখন বড়ার রং হলকা খয়েরি হতে শুরু হবে। তখনই প্যান থেকে তুলে একটা পাত্রে সংগ্রহ করে রাখেন। তারপর এই বড়া গরম ভাত আর ডালের সঙ্গে থানকুনি পাতার বড়া পরিবেশন করবেন দেখবেন খেতে কিন্তু ভালোই লাগবে।

থানকুনি পাতার রেসিপি

সাধারনত গরম ভাতের সাথে থানকুনি পাতা খাওয়া যায়। তবে থানকুনি পাতার ভর্তা তৈরি করে নিতে পারেন। তবে তার জন্য় প্রয়োজন পড়বে তিনটে থানকুনি পাতার সাথে লাগবে দুটো কাঁচা মরিচ ও ১ চামচ কালো জিরা এবং ১ চামচ তেল ও সম পরিমাণ চিনি।

আপনাকে প্রথমে থানকুনি পাতা গুলিকে ভাল করে ধুয়ে নিতে হবে তারপর পাঁচ মিনিট হালকা গরম জলে ভিজিয়ে নিতে হবে। তারপর সময় হয়ে গেলে পানিটাকে ভালো করে ছেঁকে নিতে হবে। তারপর থানকুনি পাতা ও কালো জিরে এবং নুন, চিনি এবং কাঁচা মরিচ ফেলে একটা পেস্ট বানিয়ে নিতে হবে। তারপর হালকা আঁচে এক চামচ সরষের তেল গরম করে তাতে পেস্টটা মিশিয়ে ২ মিনিট একটু নাড়িয়ে নিতে হবে। এরপর গরম ভাতের সাথে পরিবেশন করতে পারবেন।

থানকুনি পাতা পানী তৈরি

এই ধরনের পানীয় তৈরি করতে যা লাগে তা হলো ২৫০ গ্রাম থানকুনি পাতা নিয়ে ভাল করে পরিষ্কার করে নিতে হবে। এরপর একটা গ্লাসে থানকুনি পাতাগুলি নিয়ে তাতে এক কাপ পানি মিশিয়ে নিতে হবে। এরপর সেই মিশ্রণটা ব্লেন্ডারে ফেলে ভাল করে মিশাতে হবে। এরপর ছেঁকে নিয়ে তাতে ৪ চামচ চিনি ও এক চিমটে লবণ মিশিয়ে যতক্ষণ গরম করবেন, চিনিটা ঠিক মতো ততক্ষণ না মিশে যায়। এরপর মিশ্রণ টি একটু ঠান্ডা করে নিবেন। ঠান্ডা হয়ার পর  ২০০ এম এল পানি নিয়ে তাতে অল্প করে লেবুর রস এবং ৫০ এমএল থানকুনি পাতা থেকে তৈরি সেই মিশ্রণ টি মিশিয়ে নিবেন তারপর পান করবেন।

আরও পড়ুন: এক ঝলক দেখে নিন বাসক পাতার উপকারিতা

থানকুনি পাতার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

এই থানকুনি পাতার ক্ষতি বলতে সাধারনত ১-২ চামচ থানকুনি পাতার রস অথবা অল্প করে কাঁচা থানকুনি পাতা খেলে তেমন কোন ক্ষতি হবে না। তবে এর পরিমান বেশি খেলে সমস্যা হবে। তবে সে ক্ষেত্রে একাধিক সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। যেমন-

  • পেটের মারাত্মক যন্ত্রণা সৃষ্টি হতে পারে।
  • বমি ও মাথা ঘোরার মতো সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।
  • অ্যালার্জিক বা চুলকানি এর রিঅ্যাকশন হওয়ার সম্ভ্যবনা হতে পারে।
  • রক্তচাপ হঠাৎ করে কমে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটতে পারে। হেপাটাইটিস বা লিভারের রোগে বাড়তে পারে।
  • অন্যন্য রোগিদের তাঁদেরও থানকুনি পাতা খাওয়া উচিত নয়।
  • অপারেশন এর দু’সপ্তাহে আগে থেকে থানকুনি পাতা এড়িয়ে চলতে হবে।

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ আমরা এই ওয়েবসাইটে থানকুনি পাতার ঔষধি গুনাগুন ও ব্যবহারবিধি সমন্ধ্যে তথ্য প্রকাশ করেছি, বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জনে জন্যে। বিশেষ প্রয়োজনে চিকিৎসাকের পরামর্শ নিয়ে ঔষধ সেবন করবেন। নতুবা আপনি মানসিক বা শারীরিক ক্ষতি গ্রস্থ হতে পারেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *