তুলসি পাতার ভেষজ গুণাগুণ, উপকারিতা ও ব্যবহার সমূহ

তুলসি পাতার ভেষজ গুণাগুণ, উপকারিতা ও ব্যবহার সমূহ
তুলসি পাতার ভেষজ গুণাগুণ, উপকারিতা ও ব্যবহার সমূহ

তুলসী অর্থ যার তুলনা নেই। তুলসী একটি ভেষজ গাছ যার বৈজ্ঞানিক নাম Ocimum Sanctum।  হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে এটি একটি পবিত্র উদ্ভিদ হিসাবে সমাদৃত। ভেষজ তুলসী পাতার সুগন্ধিযুক্ত, রুচিকর, কটু তিক্তরস। এটি সর্দি, কাশি, কৃমি ও মুত্রকর এবং বায়ুনাশক, এন্টিসেপটিক ও হজমকারক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

তুলসী পাতার ব্যবহার: আমাদের দেশে ছেলেমেয়েদের সর্দি-কাশিতে তুলসী পাতার রস  ব্যাপক ভাবে ব্যবহৃত হয়। এসব ক্ষেত্রে কয়েকটি তাজা তুলসী পাতার রসের সাথে একটু আদার রস ও মধুসহ খাওয়ানো হয়। বাচ্চাদের সর্দি-কাশিতে এটি বিশেষ ফলপ্রদ। তাজা তুলসী পাতার রস মধু, আদা ও পিঁয়াজের রসের সাথে এক সাথে পান করলে সর্দি বের হয়ে যায় এবং হাপানিতে আরাম হয়।

তুলসি পাতার ভেষজ গুণাগুণ, উপকারিতা ও ব্যবহার সমূহ

তুলসী গাছের ঔষধি গুণাগুণ:-

১. পেট কামড়ানো, কাশি: তুলসী পাতার রসে মধু মিশিয়ে খেলে বাচ্চাদের পেট কামড়ানো, কাশি ও লিভার দোষে উপকার পাওয়া যায়।

২. ম্যালেরিয়া: তুলসী পাতা ও শিকড়ের ক্বাথ ম্যালেরিয়া জ্বরের জন্য উপকারী। ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক হিসেবে প্রতিদিন সকালে গোল মরিচের সাথে তুলসী পাতার রস খেতে হয়। নিয়মিত কয়েকদিন খেলে ম্যালেরিয়া জ্বরের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।

৩. ঘামাচি, চুলকানি ও অন্যান্য চর্মরোগে: তুলসী গাছের পাতা ঘামাচি ও চুলকানি রোধ করতে সাহায্য করে। তুলসী পাতা ও দুর্বার ডগা বেটে গায়ে মাখলে ঘামাচি ও চুলকানি ভাল হয়। তুলসিপাতার রসে লবন মিশিয়ে দাদে লাগালে উপশম হয়।

৪. বসন্ত, হাম: তুলসী পাতা বসন্ত, হাম, ফোঁড়া ইত্যাদি দূর করতে মারাত্বক ভাবে কাজ করে । বসন্ত, হাম প্রভৃতির পুঁজ ঠিকমত বের না হলে তুলসী পাতার রস খেলে তাড়াতাড়ি বের হয়ে আসবে।

৫. পেট ব্যথা: অজীর্ণজনিত পেট ব্যথায় তুলসী পাতার উপকার তুলনা করা যায় না। এটি হজমকারক। প্রতিদিন সকালে ১৮০ গ্রাম পরিমান তুলসী পাতার রস খেলে পুরাতন জ্বর, রক্তক্ষয়, আমাশয়, রক্ত অর্শ এবং অজীর্ণ রোগ সেরে যায়।

৬. ক্রিমি: তুলসী পাতা ক্রিমি নিষ্কাশন করে। তুলসী পাতার রসের সাথে লেবুর রস মিশিয়ে খেলে ক্রিমি রোগে উপকার পাওয়া যায়।

৭. বাত ব্যথা: তুলসী পাতা বাত ব্যথা দূর করতে সাহায্য করে। বাত ব্যথায় আক্রান্ত স্থানে তুলসী পাতার রসে ন্যাকড়া ভিজিয়ে পট্টি দিলে ব্যথা সেরে যায়।

৮. কীট-পতঙ্গ কামড়ালে: মাঝে মধ্যেই আমরা দেখি কীট-পতঙ্গ কামড়ে দিয়েছে। বোলতা, ভীমরুল, বিছা প্রভৃতি বিষাক্ত কীট-পতঙ্গ কামড়ালে ঐ স্থানে তুলসী পাতার রস গরম করে লাগালে জ্বালা-যন্ত্রণা কম হয়।

৯. যৌনদূর্বলতা : তুলসী মূল শুক্র গাঢ়কারক এবং বাজীকারক। তুলসী পাতার ক্বাথ, এলাচ গুঁড়া এবং এক তোলা পরিমাণ মিছরী পান করলে ধাতুপুষ্টি সাধিত হয় যতদিন সম্ভব খাওয়া যায়।  এটি অত্যন্ত ইন্দ্রিয় উত্তেজক। প্রতিদিন এক ইঞ্চি পরিমাণ তুলসী গাছের শিকড় পানের সাথে খেলে যৌনদূর্বলতা রোগ সেরে যায়।

১০. জ্বর-সর্দি নিরাময়ে (Fever-cold Remedies): তুলসী পাতা জ্বর-সর্দি নিরাময়ে প্রাকৃতিক উপায় পালন করে। যারা সহজেই সর্দিতে আক্রান্ত হয় (বিশেষ করে শিশুদের) তারা কিছুদিন ৫ ফোঁটা মধুর সাথে ১০ ফোঁটা রস(ছবি) খেলে সর্দি প্রবণতা দূর হয়। শুষ্ক তুলসী পাতার ক্বাথ সর্দি, স্বরভঙ্গ, বক্ষপ্রদাহ, উদারাময় প্রভৃতি রোগ নিরাময় করে থাকে। শ্লেষ্মার জন্য নাক বন্ধ হয়ে কোনো গন্ধ পাওয়া না গেলে সে সময় শুষ্ক পাতা চূর্ণের নস্যি নিলে সেরে যায়।

১১. হার্টের অসুখ: তুলসী পাতায় আছে ভিটামিন সি ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। এই উপাদান গুলো হার্টকে বিভিন্ন সমস্যা থেকে মুক্ত রাখতে সহায়তা করে। তুলসী পাতা হার্টের কর্মক্ষমতা বাড়ায় ও এর স্বাস্থ্য ভালো রাখে।

১২. ডায়াবেটিস থেকে মুক্তি (Get rid of Diabetes): ডায়াবেটিসের থেকে মুক্তিতে সাহায্য করে তুলসী পাতা। যেটা ডায়াবেটিসকে রোধে অনেকটাই সাহায্য করে। রক্তে অতিরিক্ত গ্লুকোজকে নিয়ন্ত্রণ করে। এটি কিডনি ও লিভারকে মেটাবলিক ড্যামেজের হাত থেকে বাঁচায়। যেটি রক্তে অতিরিক্ত গ্লুকোজের কারণে হয়।

১৩. মানসিক চাপ: তুলসী পাতা মানসিক চাপ থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। তুলসীর ভিটামিন সি ও অন্যান্য অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট গুলো মানসিক চাপ কমাতে সহায়তা করে। এই উপাদান গুলো নার্ভকে শান্ত করে। এছাড়াও তুলসী পাতার রস শরীরের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে।

১৪. রক্ত দূষণ : তুলসী পাতা রক্ত দূষণ মুক্ত করে। কোন কারনে রক্ত দূষিত হলে কাল তুলসিপাতার রস কিছুদিন খেলে উপকার পাওয়া যায়।

১৫. ক্যান্সার থেকে মুক্তি (Freedom from cancer): তুলসী গাছের পাতায় আছে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা ক্যান্সার থেকে মুক্তির উপায় হয়। তুলসী শুধু শরীরকে ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার হাত থেকেই বাঁচায় না বরং ক্যান্সার হলে সারিয়ে তুলতেও দারুন ভাবে সাহায্য করে। বিভিন্ন গবেষণায় থেকে জানা  গেছে যে, “তুলসী যারা নিয়মিত খান তাদের ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার সুযোগ অনেক কম। অন্যদিকে তুলসীর মধ্যে যে ফাইটোক্যামিকাল রয়েছে তা লাং , লিভার, এবং স্কিন ক্যান্সার রোধে সাহায্য করে। এটি তুলসীতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের ক্ষমতাকে বাড়িয়ে দেয়। এবং কান্সারকে ছড়িয়ে পড়তে দেয় না। ক্যান্সারের সময় যে রেডিয়েশন দেওয়া হয় তার ফলে নানা সমস্যা হয়। কারোর চুল উঠে যায় একদম। তুলসী এই রেডিয়েশনের ফলে হওয়া এই ধরনের সমস্যাগুলিকে প্রতিরোধ করতেও সাহায্য করে।”

১৬. সুস্থ ও বয়স রোধ করা: তুলসী পাতা দিয়ে চায়ের মত করে খেলে দীর্ঘদিন সুস্থ থাকা যায়। তুলসী চা হিসাবে এটি বেশ জনপ্রিয়। ভিটামিন সি, ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস ও এসেন্সিয়াল অয়েল গুলো চমতকার অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের হিসেবে কাজ করে যা বয়সজনিত সমস্যা গুলো সমাধান করে।

১৭. প্রস্রাবজনিত জ্বালা: তুলসীর বীজ পানিতে ভিজালে পিচ্ছিল হয়। এই পানিতে চিনি মিশিয়ে শরবতের মত করে খেলে প্রস্রাবজনিত জ্বালা যন্ত্রনায় বিশেষ উপকার হয়।

১৮. কালো দাগ: মুখে বসন্তের কাল দাগে তুলসীর রস মাখলে ঐ দাগ মিলিয়ে যায়। হামের পর যে সব শিশুর শরীরে কালো দাগ হয়ে যায় সে ক্ষেত্রে তুলসী পা্তার রস মাখলে গায়ে স্বাভাবিক রং ফিরে আসে।

তুলসী পাতার দুটি রেসিপি

বিভিন্নভাবে খাদ্য তালিকায় তুলসী পাতার ব্যবহার করতে পারেন। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় দুটি রেসিপি :
১. তুলসীর সালাদ (Tulsi salad):
১২-১৫টি তুলসী পাতা, এক কাপ শসা কুচি, ৫০ গ্রাম টুকরা পনির, একটি লেবুর রস, এক টেবিল চামচ অলিভ অয়েল, সামান্য লবণ এবং স্বাদের জন্য মরিচ। সব উপকরণ মিশিয়ে উপভোগ করুন তুলসীর সালাদ।

২. তুলসীর চা (Tulsi tea):
আধা চামচ আদা কুচি, ১২-১৫টি তুলসী পাতা এবং এক চামচের চার ভাগের এক ভাগ এলাচ গুঁড়ো তিন কাপ পানিতে ১০ মিনিট ধরে ফুটিয়ে নিন। সামান্য মধু এবং লেবুর রস মিশিয়ে উপভোগ করুন তুলসীর চা।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Exit mobile version