ভারতবর্ষে চিরতা প্রাচীনাকাল থেকে খুব প্রয়োজনীয় ভেষজ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। চিরতা আদিমযুগ থেকে ভারতবর্ষে রয়েছে। এই গাছটির উৎপত্তি ভারতের হিমালয়ের পাদভূমিতে। আর এই হিমালয় থেকেই ভারতের বিভিন্ন জায়গায় সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পরে এই মহৌষধী গাছ চিরতা। এটি ইউরোপ মহাদেশে প্রবেশ করে ১৮৩৯ সালে। যা প্রাচীন আয়ুর্বেদ ও চরক সংহিতায় এর ব্যাখ্যা করা হয়েছে। রোগ নিরাময়ে চিরতার পুরো গাছটিকে ব্যবহার করা হয়। এই গাছ খুবই তিতা বলে এর নাম করণ করা হয়েছে চিরতা। মানবদেহের বিভিন্ন প্রকার রোগের কাজ করে এই চিরতা। রাসায়নিক উৎপাদনে চিরতা ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন ভাবে গবেষণার ফলে এর প্রমান করেছে বিজ্ঞানীরা। মানবদেহের বিভিন্ন প্রকার রোগ নিরাময় করতে এই চিরতা ব্যবহার করা হয়। যেমন : চোখের জ্যোতিবর্ধক,জ্বর,হৃৎপিণ্ড,যকৃত,হাঁপানি,হজমকারক ও লিভার প্রতিরোধে কাজ করে।
গাছের পরিচিতি
চিরতা গাছ অনেক নাম পরিচিত। এই গাছটি তিতা বলে এর নাম হয়েছে চিরতা। এই গাছটির আয়ুর্বেদিক নাম কিরাততিক্তা। চিরতা গাছকে বাংলায় বলা হয় কালোমেঘ,ইংরেজিতে বলা হয় চিরেত্তা (Chitretta)ইংরেজি নামের অর্থ সবুজ চিরতা,তামিল নাড়ুতে এটি নিলাভেম্বু নাম পরিচিত,আরব মহাদেশে এর নাম কাসাবুজাজারেয়ী, হিন্দি নাম চিরেইতা এবং পাঞ্জাবী নামও চিরেইতা।
আরো পড়ুন : পাকস্থলীর আলসার ভালো করার খাবার
যে সব রোগের মহৌষধ চিরতা
চিরতা বিভিন্ন রোগের কাজ করে থাকে। প্রাচীনকাল থেকে চিরতার ব্যবহার করা হয়ে আসছে। এটি রাসায়নিক ও আয়ুর্বেদিক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আমরা এই গাছের বিভিন্ন প্রকার উপকার সম্পর্কে আজ আলোচনা করবো। এই গাছ কি কি রোগের উপকার করে তা নিয়ে নিম্নে তুলে বিস্তারিত ধরলাম।
১. অ্যালার্জি সারায়
অ্যালার্জি কম বেশি সকল মানুষের দেহে হয়ে থাকে। অ্যালার্জি বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে। মানুষের শরীরের বিভিন্ন অংশে অ্যালার্জি হয়। অনেক খাবার আছে যা খেলে অ্যালার্জি দেখা দেয়,যেমনঃ চিংড়ি মাছ, ইলিশ মাছ,পুঁইশাক, বেগুন,হাঁসের ডিম,চাল কুমড়া ইত্যাদি খাবার। অ্যালার্জি হলে হলে শরীর চুলকায়। চুলকানি হওয়ার কারণে জায়গাটা ফুলে লাল হয় এবং চাকা চাকা হয়ে যায়। এই রোগ সরাতে চিরতা অনেক সুন্দর কাজ করে থাকে। আপনারা যদি গরোম পানিতে চিরতার গুঁড়া ভিজিয়ে নিয়ে খেতে পারেন তাহলে আপনার অ্যালার্জি নিমিষেই শেষ হয়ে যাবে। গরম পানিতে চিরতার গুঁড়া আগের দিন রাতে ভিজিয়ে রাখুন,পরের দিনে সকালে পানিটা ছেঁকে দিনের মধ্যে ৩ থেকে ৪ বার খেতে পারলে,আপনার দেহে আর কখনই এই সমস্যা দেখা দিবে না। আর অ্যালার্জি জাতীয় খাবার থেকে দূরে থাকতে হবে। তাহলে আর কখনই আপনার দেহে অ্যালার্জির মতো সমস্যা দেখা দিবে না।
২. জ্বর সারায়
জ্বর সাধারণত সব সময়ে দেখা দেয়। জ্বর হলে সেই সাথে সর্দি ও কাশি দেখা দেয়। শরীর খুব খারাপ হয়ে যায় হাত-পা চিবোয় বা কামড়ায় থাকে। তাই জ্বর সারাতে আপনারা চিরতার গুঁড়া ব্যবহার করতে পারেন। আপনারা ৫০০ গ্রাম পানিতে ১০ থেকে ১৫ গ্রাম চিরতা গুঁড়া ভালোভাবে সিদ্ধ করে নিতে হবে। সিদ্ধ করা পানি ঠান্ডা করে নিয়ে তার পরে খেতে হবে। তবে পানিটা কিন্তু অবশ্যই ভালোভাবে ছেঁকে নিতে হবে। এইভাবে কয়েকদিন নিয়মিত খেলে আপনার জ্বর ভালো হয়ে যাবে।
আরো পড়ুন : রাতকানা রোগের কারণ, লক্ষণ, প্রতিকার ও চিকিৎসা
৩.কৃমি সারায়
কৃমি মানবদেহের অনেক ক্ষতি করে থাকে। আপনার চেহারা নষ্ট করে দিবে যদি পেটের ভিতরে কৃমি হয়। কৃমি হলে পেটের ভিতরে মোচড়া মুচরি করবে ,যা আপনাকে স্বাভাবিক ভাবে থাকতে দিবে না। পেতে কৃমি হলে আপনারা চিরতা খেতে পারেন। আপনার পেটের উপরের অংশটা মোচড়ায়,ব্যথা করে তাহলে আপনি পরদিন সকালে চিরতা গুঁড়া মধু সহ খেতে পারেন। খাওয়ার পরে যদি মুখ তিতা হয় তাহলে পানি খেতে পারেন। চিরতা খেলে কৃমির উপদ্রব চলে যাবে আপনার শরীর সুস্থ হবে। তাই কৃমি সরাতে চিরতার গুঁড়া খেতে পারেন।
৪. ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে
ডায়াবেটিসকে সকল রোগের মা বলা হয়। ডায়াবেটিস হলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে যায়। এই রোগ বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে। চিরতা খাওয়ার মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা যায়। চিরতায় দেহে অগ্ন্যাশয়ের ইনসুলিন তৈরী করতে ত্বরান্বিত করে থাকে। তাই ডায়াবেটিসকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে প্রতি দিন চিরতার গুঁড়া গ্রাম পানিতে ভিজিয়ে খেতে পারেন। আগেরদিন রাতে ভিজিয়ে রেখে পরদিন সকাল বিকাল তা খেতে হবে। তাই ডায়াবেটিসকে নিয়ন্ত্রণ করতে এই চিরতা অনেক বেশি কাজ করে।
৫. প্রবল হাঁপানিতে কাজ করে
হাঁপানি এমন একটি রোগ যা মানুষকে খুবই কষ্ট দিয়ে থাকে। হাঁপানি আছে এমন মানুষের জন্য শীতকাল খুবই কষ্ট দায়ক। হাঁপানি থাকলে ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে তাদের সর্দি-কাশি বেড়ে যায়। যাদের এই রকম হাঁপানি অথবা অর্শ্বে রক্তপড়া বন্ধ হওয়ায় চিন্তা করছেন। তারা প্রতিদিন মধুর সাথে চিরতা চূর্ণ খেতে পারেন। এক সপ্তাহ নিয়মিত মধুর সাথে চিরতা চূর্ণ খেতে পারলে আপনার হাঁপানি বা একজিমা রক্ষাপেতে পারেন। প্রতি ৩০ মিনিট পর পর আধা গ্রাম চিরতা চূর্ণ মধু মিশিয়ে খেতে হবে। তাই প্রবল হাঁপানি থেকে সুস্থ হওয়ার জন্য চিরতা খেতে পারেন।
৬. চুলকানি ভালোকরে
চুলকানি সাধারণত এক প্রকার অসতর্কতা থাকার কারণে হয়ে থাকে। এটি গরমের সময় বেশি দেখা দেয়। চুলকানি সরাতে চিরতা অনেক বেশি কাজ করে থাকে। আপনার শরীরে চুলকানি থাকলে ২০ গ্রামে চিরিত গুঁড়া নিন ,তার পরে তা পরিমান মতো ১০০ গ্রাম সরিষা তেলে ভালোভাবে জ্বাল করিয়ে নিন। জ্বাল করা তেলফেনা মুক্ত হলে তার পরে চিরতা গুঁড়ো গুলো সেখানে দিন। এখন ভালোকরে জ্বাল করার পরে নামিয়ে তা ভালোভাবে ছেঁকে নিতে হবে। তবে খেয়াল রাখবেন চিরতা গুড়োগুলো যেন পুড়ে না যায়। এই তেল প্রতিদিন মালিশ করলে আপনার চুলকানি সেরে যাবে। ৪ থেকে ৫ দিন ব্যবহার করলে আপনার দেহে কোনো প্রকার চুলকানি থাকবে না। তাই চুলকানি ভালো করতে এটি খুব বেশি কাজ করে।
৭. রক্তশূণ্যতা কমায়
চিরতা রক্ত শুন্যতা দূর করতে কাজ করে।মানবদেহে নতুন করে রক্তকোষ গঠন করে থাকে চিরতা। এমনকি মহিলাদের মাসিকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ও ঋতুস্রাব ভালো করতে কাজ করে। মানুষের দেহের কোথাও কেটে গেলে দ্রুত রক্ত পড়া বন্ধ করতে চিরতার রস লাগিয়ে দিন। নিয়মিত চিরতা খেলে দেহের রক্ত শূন্যতা কবে যায়। অনেকের নাক দিয়ে রক্ত পরে,চিরতার রস লাগিয়ে দিলে সাথে সাথে রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে যাবে।
আরো পড়ুন : মরিয়ম ফুলের উপকারিতা
৮. চুল পড়া বন্ধ করে
চুল পড়া ও চুল পাকা এখন একটি কমন সমস্যা। চুল পাকতে ও চুল পড়ার জন্য এখন কোনো বয়স লাগে না। চুল উঠতে উঠতে ঘন চুল পাতলা হয়ে মাথা টাক পরে যাচ্ছে। এমন সমস্যার জন্য সমাধান দিতে পারে চিরতা। চিরতা গুঁড়া গরম পানিতে ভিজিয়ে রেখে পরের দিন সকালে গোসল করার সময় তা দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। ১ কাপ গরম পানিতে ৩-৮ গ্রাম চিরতা গুঁড়া ভিজিয়ে রাখতে হবে। পর দিন সকালে পানিটা ভালোভাবে ছেঁকে নিয়ে ওই পানি দিয়ে মাথা ভালোভাবে ধুতে হবে। একই ভাবে কয়েকদিন ব্যবহার করলে চুল পড়া বন্ধ হবে। আপনার মাথার খুসকি ভালো করতে চিরতা ফুল নারিকেল তেলের সাথে ভেজে ওই তেল মাথায় ব্যবহার করলে খুসকি ভালো হয়ে যাবে।
৯. হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়
চিরতার মাঝে শক্তিশালী এন্টি অক্সিডেন্ট থাকে। চিরতার মাঝে থাকা এন্টি অক্সিডেন্ট বার্ধক্যকে বিলম্বিত করতে পারে। নিয়মিত চিরতা সেবনে দেহের বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ করে যেমনঃ ক্যানসার,স্ট্রোক,হৃদরোগে ইত্যাদি। তাই চিরতা নিয়মিত খেতে পারলে হৃদরোগের ঝুঁকি থাকবে না।
১০. বমি কমায়
চিরতা বমি কমাতে অনেক ভালো কাজ করে। মহিলাদের গর্ভাবস্থায় বমির উদ্রেক দেখা দেয়। মানুষের দেহে জ্বর এর মাত্রা বেড়ে গেলে বমি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। খাবারে ভেজাল থাকলেও সাধারণত বমি হয়। বমি হলে শরীর দুর্বল হয়ে পরে। এমতাবস্তা দেখা দিলে আধা লিটার গরম পানিতে ৫-৬গ্রাম চিরতাগুঁড়া ভিজিয়ে তা ২-৩ ঘন্টা পরে ছেঁকে নিয়ে খেতে হবে। তাহলে আর বমি হবে না। তাই বমি বন্ধ করতে চিরতা খেতে পারেন।
আরো পড়ুন : নিয়মিত কিসমিস খাওয়ার ১০টি উপকারিতা
১১. পচা ঘা সারে
ঘা এমন একটি রোগ যা দেখতে খুবই খারাপ লাগে। ঘা বেশি দিন থাকলে বড়ো ধরণের সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই ঘা সরাতে চিরতা ব্যবহার করতে পারেন। চিরতা গরম পানিতে ভিজিয়ে রেখে কয়েক ঘন্টা পর সেই পানি দিয়ে আপনার দেহের ক্ষত স্থান বা পচা ঘা ভালোবাভে ধুয়ে নিন। কয়েক দিনেই ঘা ভালো হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে ৮-১০ গ্রাম চিরতা গুঁড়া আধা লিটার পানিতে আগের রাতে বা কয়েক ঘন্টা পূর্বে গরম পানিতে ভিজিয়ে রাখুন। পরদিন সেই পানি দিয়ে আপনার ঘা ভালোভাবে ধুয়ে নিন। এভাবে কয়েক দিন ব্যবহার করলে সব ধরণের ঘা ভালো হয়ে যাবে।
চিরতা এমন একটি গাছ যা মানব দেহের অনেক উপকার করে থাকে। এটি প্রাচীন কাল থেকে ব্যবহারিত হয়ে আসছে। এর অনেক গুনাগুন যা বলে শেষ করা যাবে না। আমরা আপনাদের সুবিদার্থে এর কিছু উপকার সম্পর্কে তুলে ধরলাম। আশা করা যায় এই সব রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে, যদি নিয়মিত এই চিরতার ব্যবহার করতে পারেন। এই পোস্ট সম্পর্কে যদি আরো কিছু জানার থাকে আমাদের কাছ থেকে,তাহলে কমেন্ট করতে পারেন। আমরা যথেষ্ট সহযোগিতা করার চেষ্টা করবো। ধন্যবাদ