রংপুরে যেন প্রকৃতিতে রঙ ছড়িয়ে রয়েছে। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, নদী- নালা, পাখ-পাখালীর শব্দ, সরল মনের মানুষের আচরণ, সুস্বাদু পানি ও খাবার যে কাউকে মনোমুগ্ধ করে তুলবে। আজকে রংপুরের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস সহ রংপুরের জনপ্রিয়তার কারণ তুলে ধরবো।
বাংলাদেশের মধ্যে রংপুর একটি অন্যতম প্রধান শহর এবং ১৮৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের প্রাচীনতম পৌর কর্পোরেশনের একটি। রংপুর শহর ১৬ ডিসেম্বর ১৭৬৯ সালে বিভাগীয় সদর দপ্তর হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। রংপুর বিভাগ বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ৮টি জেলা নিয়ে গঠিত। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ জানুয়ারিতে বাংলাদেশের সপ্তম বিভাগ হিসেবে ঘোষিত হয়।
রংপুরের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
১৫৭৫ সালে মুঘল সাম্রাজ্যের অধিপতি আকবরের সেনাপতি রাজা মান সিংহ রংপুর জয় করেন এবং ১৬৬৮ সালে সমগ্র রংপুরে মোগলদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা পায়। এ অঞ্চলের মোগালবাসা এবং মোগলহাট নামগুলি দীর্ঘ মোগল শাসনের চিহ্ন বহন করছে। পরে রংপুর ঘোরাঘাট সরকারের অধীনে চলে আসে এবং পর্বর্তিতে ১৮’শ শতকের শেষের দিকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে রংপুরে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল।
১৮৯০ সালে তৎকালীন পৌর কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান ডিমলার জমিদার বাড়ির রাজা জানকীবল্লভ সেন রংপুর শহরে জলাবদ্ধতা নিরসনে তার মা চৌধুরানী শ্যামাসুন্দরী দেবী’র নামে যে খালটি পুনঃখনন করেন তাই আজকের শ্যামাসুন্দরী খাল নামে পরিচিত এবং তার দানকৃত বাগান বাড়ির জমিতে ১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দে আজকের পৌরসভা ভবনটি গড়ে ওঠে।
রংপুর কিসের জন্য বিখ্যাত
রংপুর মূলত তামাক, ইক্ষুর জন্য বিখ্যাত বলা হয়। এছাড়াও রংপুরে প্রচুর পরিমাণ ধান-আলু-পাট ও হাড়িভাঙ্গা আম উৎপাদিত হয়। হাড়িভাঙ্গা আম স্থানীয় বাজার সহ সারাদেশের বাজারে ব্যাপক হরে চাহিদা রয়েছে। এখানকার মানুষ অনেক সহজ-সরল প্রকৃতির। সহজেই সকলকেই আপন মনে করে। এছাড়াও তাজহাট রাজবাড়ী, ভিন্নজগত, ঘাঘট প্রয়াস পার্ক, চিকলির পার্ক, তিস্তা সড়ক ও রেল সেতু, মিঠাপুকুর শালবন সহ অনেক দর্শনীয় স্থানের কারণে রংপুর জেলা অনেক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
রংপুর নামকরণের ইতিহাস
রংপুরের নামকরণের সঠিক তথ্য পাওয়া এখনো পাওয়া যায় নাই । রংপুরের নামকরণের ক্ষেত্রে লোকমুখে প্রচলিত আছে যে, পূর্বের ‘রঙ্গপুর’ থেকেই কালক্রমে এই নামটি এসেছে। লোক মুখে জানা যায়, মহাভারতের সময়ে প্রাগজ্যোতিষপুরের রাজা ভগদত্তের রঙ মহল ছিল রংপুরে এবং সেই রঙমহল হতে নাম হয়েছে রঙ্গপুর। কেউ কেউ বলেন, ভগদত্তের কন্যা পায়রাবতীর নামানুসারে (বেগম রোকেয়ার জন্মভূমি) পায়রাবন্দের নামকরণ হয়েছে । অনেকের মতে, রংপুরে বস্ত্ররঞ্জনী কারখানা ছিল। যেখানে পাট নির্মিত বস্ত্রে বা চটে রং করা হতো। সেকারণে রংপুরকে রংরেজপুর বলা হতো এবং তার পরিবর্তে রঙ্গপুর (রংপুর) হয়েছে।
তবে ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, ভারত উপমহাদেশে ইংরেজরা নীলের চাষ শুরু করে। এই অঞ্চলে মাটি উর্বর হবার কারণে এখানে প্রচুর নীলের চাষ হত। আর সেই নীলকে স্থানীয় লোকজন রঙ্গ নামেই চিনতো। কালের বিবর্তনে সেই রঙ্গ থেকে রঙ্গপুর এবং তা থেকেই আজকের রংপুর নামকরণ হয়েছে। তবে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন রংপুরের নামকরণের ক্ষেত্রে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খলজীর অবদান গ্রহণযোগ্য। কেননা রঙ্গপুর শব্দটি ফার্সিশব্দ। আর তাই সঙ্গত কারণে বখতিয়ার শাসন আমলেই রংপুরের নাম রঙ্গপুর হয়েছে।
অপর একটি প্রচলিত ধারণা থেকে জানা যায় যে, রংপুর জেলার অপর নাম জঙ্গপুর। ম্যালেরিয়া রোগের প্রাদুর্ভাব থাকায় কেউ কেউ রংপুর জেলাকে যমপুর বলেও ডাকত। তবে এই জেলা সুদূর অতীত থেকে আন্দোলন প্রতিরোধের মূল ঘাঁটি ছিল। তাই জঙ্গপুর নামকেই রংপুরের আদি নাম হিসেবে ধরা হয়। জঙ্গ অর্থ যুদ্ধ, পুর অর্থ নগর বা শহর। গ্রাম থেকে আসা মানুষগুলোর বেশিরভাগ ইংরেজদের অত্যাচারে নিহত হত অথবা ম্যালেরিয়ায় মারা যেত। তাই গ্রামের সাধারণ মানুষ শহরে আসতে ভয় পেত। সন্দেহাতীত ভাবেই বলা যায় সুদূর অতীতে রংপুর জেলা একটি রণভূমি ছিল। ত্রিশের দশকের শেষ দিকে রংপুর জেলায় কৃষক আন্দোলন যে ভাবে বিকাশ লাভ করে ছিল তার কারণে এই জেলাকে লাল রংপুর হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল।
রংপুর জেলার প্রশাসনিক অঞ্চলঃ
রংপুর জেলায় ৮টি উপজেলা রয়েছে। এগুলো হল:
- কাউনিয়া,
- পীরগঞ্জ,
- পীরগাছা,
- গংগাচড়া,
- তারাগঞ্জ,
- বদরগঞ্জ,
- মিঠাপুকুর এবং
- রংপুর সদর।
রংপুর জেলার বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের নামঃ
রংপুর জেলার অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব রয়েছে যাদের অবদান অনেক। যারা রংপুর বাসীদের তথা পুরো বাংলাদেশের জন্য পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ ভাবে কাজ করে গেছেন। নিম্নে তাদের কিছু তালিকা তুলে ধরলাম।
- আকবর আলী, ক্রিকেটার
- আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, বাংলাদেশের প্রথম প্রধান বিচারপতি ও ষষ্ঠ রাষ্ট্রপতি
- আনিসুল হক, লেখক, নাট্যকার ও সাংবাদিক
- এইচ এন আশিকুর রহমান , রাজনীতিবিদ ও সংসদ সদস্য
- এম এ ওয়াজেদ মিয়া, খ্যাতনামা পরমাণু বিজ্ঞানী
- লেফটেন্যান্ট জেনারেল পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ, বাংলাদেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ও ষষ্ঠ সেনাপ্রধান, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী
- হেয়াত মামুদ, মধ্যযুগের কবি
- বেগম রোকেয়া, বাংলার মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত
- দেবী চৌধুরানী
- দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী, ভারতীয় ভাস্কর, চিত্রশিল্পী এবং ললিত কলা একাডেমীর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি
- খান বাহাদুর শাহ্ আব্দুর রউফ, সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদ
- মশিউর রহমান – সাবেক প্রধানমন্ত্রী
- মুহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান –বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক সেনাপ্রধান। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মুক্তিযোদ্ধা ও বীর বিক্রম।
- মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা, মাননীয় মেয়র, রংপুর সিটি কর্পোরেশন
- মসিউর রহমান রাঙ্গা , জাতীয় পার্টির মহাসচিব ।
- মাহবুব আলম, সাহিত্যিক
- সানজিদা ইসলাম,বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের সদস্য
- টিপু মুন্সি , বাণিজ্য মন্ত্রী
- নাসির হোসেন,বাংলাদেশ জাতীয় দলের ক্রিকেটার
- রফিকুল হক, ছড়াকার, সাংবাদিক
এখানকার প্রকৃতি যেমন সুন্দর তেমনি এখানকার লোকজন সুন্দর মনের। এখানকার মানুষেরা সহজেই অন্যকে বিশ্বাস করে। এজন্য অনেক সময় প্রতারণার শিকার হয়। আবার অনেকেই একারণে রংপুরবাসীদের বোকা বলে থাকে। তারপরেও এরা বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে সবার সাথে মিলে মিশে থাকে। কেননা এরা মনে করে, বিশ্বাস হচ্ছে ভালোবাসার বন্ধন। যা রংপুরবাসী কখনো হারাতে চায় না।