বর্ষা কাল চলে এসেছে । ঘন কালো মেঘে ছেয়ে আছে আকাশ। অঝোরধারায় নেমেছে বৃষ্টি। চারদিকের থৈথৈ বৃষ্টির পানিতে শহরের রাজপথে হাঁটু জল।আপনি কী ভ্রমণের জায়গাগুলো নিজের বর্ষায় ধারণ করে একটি নতুন রূপ দিতেচান। তবে নিজ বর্ষার রয়েছে নিজস্ব আমেজ । আমরা সবাই কোথাও ঘুরতে গেলে ছবি তুলতে বা ভিডিও করতে পছন্দ করি। যদি ভাবেন শহর থেকে একটু বাইরে বের হবেন তবে মিলতে পারে মনোরম পরিবেশ ও প্রাকৃতিক দৃশ্যের দেখা। তাহলে চলুন জেনে নিই এমন কিছু জায়গার কথা ।
বর্ষা কালে যেসব যায়গায় ঘুরতে পছন্দ করেন:
চলন বিল
চলন বিল বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের একটি বৃহৎ বিল। এটি নাটোর, সিরাজগঞ্জ, এবং পাবনা জেলা জুড়ে বিস্তৃত। ভরা বর্ষায় চলনবিল হয়ে ওঠে জল-থইথই। শুধু একটি বিল নয়,অনেক বিল,খাল ও নদী নিয়ে গড়ে ওঠা জলাভূমি। বিলটি বিস্তৃত নাটোরের বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, পাবনার চাটমোহর ,সিংড়া, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর এবং সিরাজগঞ্জের তাড়াশ ও রায়গঞ্জ উপজেলার ১ হাজার ৬০০টি গ্রাম নিয়ে।সাতচল্লিশটি নদী ও অন্যান্য জলপথ চলন বিলের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়।
এর জলজ পরিবেশ ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ ও ১২টি গোত্রের ২৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ীপ্রাণী পাওয়া যায়। বর্ষার অবারিত জলে নৌকায় ভাসতে চলনবিল রাখতে পারেন ভ্রমণ তালিকায়। চলনবিলে ঘুরতে নাটোর সিরাজগঞ্জ ও পাবনা সব জায়গা থেকে যাওয়া যায়। ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর ঢাকা থেকে সিরাজগঞ্জের কাছিকাটা পাবনার চাটমোহর যাওয়া যায়। সবখান থেকেই বাসযোগে যাওয়া যাবে। ঢাকা থেকে ট্রেনযোগে চাটমোহর অথবা ভাঙ্গুড়ার বড়াল ব্রিজ স্টেশনে নেমে ভাড়ার নৌকায়ও চলনবিল ঘোরা যায়। জলমগ্ন এলাকাটা ভিন্ন রূপে ধরা দেয় বর্ষা মৌসুমে।
আরও পড়ুন: ঐতিহাসিক স্থাপনা তাজহাট জমিদার বাড়ির সৌন্দর্য
শ্রীমঙ্গল
শ্রীমঙ্গল শহরের নামকরণ শ্রীমঙ্গলের নামকরণ। দু’শ বছরের প্রাচীন শ্রীমঙ্গল শহরের নামকরণ নিয়ে ভিন্ন-ভিন্ন কাহিনী শোনা গেলেও রেকর্ড পত্রে লিপিবদ্ধ আছে শ্রীদাস ও মঙ্গলদাস নামে দু’জন প্রথমে এসে এখানে হাইল-হাওরের তীরে বসতি স্থাপন করেছিলেন। এ দু’ভাইয়ের নাম অনুসারে শ্রীমঙ্গল নামকরণ করা হয় এ জনবসতির। আরেক মহল থেকে বলা হয়েছে, শ্রীমঙ্গল শহরের অদূরে ‘মঙ্গলচন্ডী’ দেবতার একটি স্থলী ছিল। তার নামানুসারে ‘শ্রীমঙ্গল’ নামকরণ করা হয়েছে। দু’টি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ শ্রীমঙ্গল। প্রকৃতির সান্নিধ্যে বর্ষা-যাপনের অন্যতম গন্তব্য হতে পারে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল। চা শিল্পের জন্য শ্রীমঙ্গলের সুনাম ও পরিচিতি বিশ্বব্যাপি।
সাজেক ভ্যালি
কর্ণফুলী নদী থেকে উদ্ভূত সাজেক নদী থেকে সাজেক ভ্যালির নাম এসেছে। সাজেক ত্রিপুরী ভ্যালি রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার অন্তর্গত সাজেক ইউনিয়নের একটি বিখ্যাত পর্যটন স্থল। এটি রাঙ্গামাটি জেলার সর্বউত্তরে মিজোরাম সিমান্তে অবস্থিত। সাজেক বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন, যার আয়তন ৭০২ বর্গমাইল। এর উত্তরে ভারতের ত্রিপুড়া, দক্ষিণে রাঙ্গামাটির লংগদু, পূর্বে ভারতের মিজোরাম ও পশ্চিমে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলা অবস্থিত। ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ১৮০০ ফুট উচ্চতার সাজেক ভ্যালি যেন এক প্রাকৃতিক ভূ-স্বর্গ।
প্রকৃতি এখানে সকাল বিকাল রঙ বদলায়। চারপাশে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো বিস্তীর্ণ পাহাড় সারি, আর তুলোর মতো মেঘ, এরই মধ্যে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে রয়েছে নৈস্বর্গিক সাজেক ভ্যালি। বর্ষায় পাহাড়ি প্রকৃতি সবুজ হয়ে ওঠে। সাজেকে মূলত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের বসবাস রয়েছে । পাহাড়ের সবুজে ডানা মেলে সাদা-কালো মেঘ। সবুজের বেষ্টনীতে কেবলই বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা ভোরে বৃষ্টি হলে মেঘ ঢুকে পড়ে শোবার ঘর পর্যন্ত। সাজেকের মেঘ কখনো ধরা দেয় সমুদ্রের রূপে। সবুজ উপত্যকা, অপার্থিব সূর্যোদয়, জোছনায় ছড়িয়ে পড়া মেঘের দল, আকাশের মেঘের অনেক রং মিলিয়ে সাজেক যেন অন্য এক জনপদ।এই বর্ষায় সাজেক ভ্যালি দেখার পরিকল্পনা করতে পারেন।
জলপ্রপাত
জলপ্রপাত বা ঝরনা হল এমন একটি প্রাকৃতিক অবকাঠামো যেখানে নদী বা নদীর শাখার জল খুব দ্রুতগতিতে পড়ে অথবা পাহাড় বা উচ্চতর এলাকার উচ্চতার প্রান্ত থেকে জল নিম্নস্থানে পতিত হয়। এটি একটি মন্ত্রমুগ্ধ দর্শন তৈরি করে যা যুগ যুগ ধরে মানুষকে মুগ্ধ এবং অনুপ্রাণিত করে এসেছে। জলের এই মোহনীয় ক্যাসকেডগুলি বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন স্থানে পাওয়া যায়, যা প্রকৃতির সৃষ্টির শ্বাসরুদ্ধকর বৈচিত্র্য এবং সৌন্দর্য প্রদর্শন করে।
প্রচন্ড দৈত্যদের থেকে যারা সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম কৌশলের দিকে মনোযোগ দেয় যা গোপনীয়তাকে ফিসফিস করে, প্রতিটি জলপ্রপাতের নিজস্ব অনন্য আকর্ষণ রয়েছে, যা দর্শনার্থী এবং অভিযাত্রীদের তাদের বিস্ময়-অনুপ্রেরণাদায়ক উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করতে আকর্ষণ করে।বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, চট্টগ্রাম, সিলেট, মৌলভীবাজারে আছে ছোট-বড় অনেক জলপ্রপাত। নাফাখুম, ধুপপানি, জাদিপাই, হামহাম—বাহারি নামের মতো রূপেও জলপ্রপাত আছে। বৃষ্টির কারণে জলপ্রপাতের পানির প্রবাহ এতটাই বেড়ে যায়, সেই দৃশ্য একবার দেখলে আর ভুলবেন না । আপনি এই ঝর্ণার এবং ঝর্ণার সঙ্গে নিজের অপূর্ব কিছু ছবি তুলতে পারবেন, তবে সতর্কতার বিষয়টি অবশ্যই মাথায় রাখবেন।
টাঙ্গুয়ার হাওর
টাঙ্গুয়ার হাওর বাংলাদেশের সিলেটের সুনামগঞ্জ জেলায় অবস্থিত একটি হাওর। প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এ হাওর বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠা পানির জলাভূমি ।স্থানীয় লোকজনের কাছে হাওরটি নয়কুড়ি কান্দার ছয়কুড়ি বিল নামেও পরিচিত।এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার স্থান হিসাবে পরিচয়, প্রথমটি সুন্দরবন।
টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্যের মধ্যে অন্যতম হলো বিভিন্ন জাতের পাখি।টাঙ্গুয়ার হাওর ৬ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ২০ প্রজাতির সাপ, বিরল প্রজাতির উভচর, ৪ প্রজাতির কচ্ছপ, ৭ প্রজাতির গিরগিটিসহ নানাবিধ প্রাণীর আবাস। বিলুপ্ত কাছিমের মধ্যে রয়েছে হলুদ কাছিম, কড়ি কাইট্টা ও পুরা কাইট্টা। তবে বর্তমানে বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে জাত কাছিম ও ধুম কাছিম বর্ষাকালের রোমাঞ্চকর অনুভূতি নেওয়ার জন্য সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর একটি অসাধারণ জায়গা। চারদিকে থৈ থৈ পানিতে এ সময় এক শ্বাসরুদ্ধকর দৃশ্যের দেখা মেলে হাওরে। নৌকার ছাদে রাত কাটানো, জোছনায় চাঁদের রূপালি আলোর মোহনীয় রূপ নিশ্চিতভাবেই আপনাকে কিছু নান্দনিক ছবি দেবে, যদি আপনার ক্যামেরা এমন স্বল্প আলোতে ছবি তোলার উপযোগী হবে ।
আরও পড়ুন: ঘুরে আসুন হলুদের রাজ্য! – কাসেম বিল, উল্লাপাড়া, সিরাজগঞ্জ
ভাসমান পেয়ারা বাজার
বাংলাদশের দক্ষিণের তিন জেলাবরিশাল ,জালকাটি এবং পিরোজপুরের বিশাল এলাকা জুড়ে গড়ে ওঠছে মহাদেশের সবথেকে বড় পেয়ারা বাগান । পিরোজপুর জেলার সরুপকাঠি উপজেলার আটঘর ,কোরিয়ানা কয়েকজন কৃষক মিলিয়ে প্রথম শখের বসে শুরু করে পেয়ারা বাগান ।আজ তার পরিধি অনেক। বরিশাল জুড়ে বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত এবং বিভিন্ন স্থানে প্রবাহিত নদী ও খাল দেখা যায়। এ নদীর দুই সাইটে পেয়ারা গাছ লাগানো আছে। এই খালগুলো দূরে সন্ধ্যা নদীতে গিয়ে মিশেছে।
এসব খালের কোথাও বসতি, কোথাও বৃক্ষবাগান, কোথাও আবার বিঘার পর বিঘা পেয়ারাবাগান। জলমগ্ন এলাকাটা ভিন্ন রূপে ধরা দেয় বর্ষা মৌসুমে। বর্ষার সময় পর্যটকের আনাগোনাও বেড়ে যায়। খাল বেয়ে ট্রলার আর ডিঙিনৌকায় পর্যটকেরা এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় ঘুরে বেড়ানো যাবে ।পেয়ারাবাগান আর ভাসমান হাটের কারণেই পর্যটকদের অন্যতম গন্তব্য হয়ে উঠেছে ঝালকাঠির ভীমরুলি আর পিরোজপুরের নেছারাবাদ উপজেলার আটঘর কুড়িয়ানা।এই বর্ষায় ভাসমান পেয়ারা বাজারে ভ্রমণে ঘুরে আসতে পারেন।
বিছনাকান্দি
সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার রুস্তমপুর ইউনিয়নে অবস্থিত ‘বিছনাকান্দি’ মূলতঃ জাফলং এর মতোই একটি পাথর কোয়ারী।বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে খাসিয়া পাহাড়ের অনেকগুলো ধাপ দুই পাশ থেকে এক বিন্দুতে এসে মিলেছে। পাহাড়ের খাঁজে রয়েছে সুউচ্চ ঝর্ণা। ভ্রমণবিলাসীদের জন্য এই স্পটের মূল আকর্ষণ হলো পাথরের উপর দিয়ে বয়ে চলা পানিপ্রবাহ।
তাছাড়া বর্ষায় থোকা থোকা মেঘ আটকে থাকে পাহাড়ের গায়ে, মনে হতে পারে মেঘেরা পাহাড়ের কোলে বাসা বেঁধেছে। পূর্ব দিক থেকে পিয়াইন নদীর একটি শাখা পাহাড়ের নীচ দিয়ে চলে গেছে ভোলাগঞ্জের দিকে। সব মিলিয়ে পাহাড়, নদী, ঝর্ণা আর পাথরের এক সম্মিলিত ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই বিছনাকান্দি।সিলেটের অন্যান্য ভ্রমণ-গন্তব্যের মতো বিছনাকান্দিও বর্ষাকালে প্রাণবন্ত হয়ে উঠে।এই বর্ষায় বিছনাকান্দি দেখার পরিকল্পনা করতে পারেন
আরও পড়ুন: রংপুর জেলার বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান
বর্ষাকালে ভ্রমণ করা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কিছুটা কঠিন হতে পারে আবহাওয়ার জন্য। তবে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ও সতর্কতার সঙ্গে ভ্রমণ করলে আপনি নিজেকে সবুজ প্রকৃতি আর বিস্তীর্ণ জলাশয়ের মধ্যে আবিষ্কার করতে পারবেন ।