আমাদের দেশের বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলের একটি পরিচিত গাছ হচ্ছে ‘আকন্দ’। আকন্দ এক প্রকারের ঔষধি গাছ। এর বৈজ্ঞানিক নাম Calotropis gigantea (C. procera)। গাছটির বিষাক্ত অংশ হলো পাতা ও গাছের কষ। কষ ভীষণ রেচক, গর্ভপাতক, শিশু হন্তারক, পাতা মানুষ হন্তারক বিষ। সাধারণত রাস্তার ধারে বা ঝোপের পাশে প্রায়ই এই গাছের পাওয়া যায়। তবে এটি একটি মাঝারি ধরনের ঝোপ জাতীয় উদ্ভিদ। এই উদ্ভিদটির রয়েছে অনেক ভেষজ গুণাগুণ। নিচে আকন্দ গাছের গুণাগুণ বা উপকারিতা নিয়ে আলোচনা করা হলো।
আকন্দ পাতার শীর্ষ ৬টি উপকারিতা ও গুণাবলি
- আকন্দ পাতা ব্রণ ফাটাতে সাহায্য করে। এই পাতা দিয়ে ব্রণ চেপে বেঁধে রাখলে ব্রণ খুব সহজে ফেটে যায়। তখন দ্রুত্ব ভালো হয়ে যায়
- একধরনের বিছে পোকা কামড়ালে জ্বালা-পোড়া বা যন্ত্রনা হয়। জ্বালা-পোড়া বা যন্ত্রনা উপশম করতে এই পাতা ব্যবহার করা যায়।
- মানুষের কখনো শরীরের কোনো স্থানে ফোরা বা দূষিত ক্ষত হলে। সেই স্থানটিতে আকন্দ পাতা সেদ্ধ করে, সেদ্ধ পানি দিয়ে ধুয়ে দিতে হয়। এতে করে সেই স্থানে পুঁজ আর হয় না।
- অনেক সময় দেখা যায় বুকে সর্দি বসে গিয়েছে, তাহলে ভালো করে পুরনো ঘি বুকে মালিশ করতে হয়। এরপর ঘি মাখানো বুকে আকন্দের পাতা গরম করে ছেক দিলে সর্দি দ্রুত্ব ভালো হয়।
- যদি কাহারো খোস-পাচড়া বা একজিমা হয় সেই ক্ষেত্রে আকন্দের আঠার সঙ্গে চার গুণ সরিষার তেল মিশিয়ে গরম করতে হয়। তারপর গরম তেলের সঙ্গে কাঁচা হলুদের রস মিশিয়ে খোস পাচড়ায় মাখলে তা ভালো হয়ে যায়।
- হাত-পা মোচকে গেলে প্রচণ্ড ব্যথা হয়, এই আকন্দ পাতা দিয়ে গরম করে ছেক দিলে ব্যথা নিরাময় হয়।
আকন্দ গাছের ভেষজ গুণ
এই উদ্ভিদের বিভিন্ন গুণাগুণ রয়েছে তার মধ্যে ব্যবহার্য অংশ হলো ছাল, পাতা, ফুল, মূল ও কষ। বায়ুনাশক, উদ্দীপক, পাচক, পাকস্থলীর ব্যথা নিবারক, বিষনাশক, ফোলা নিবারক। প্লীহা, দাদ, শোথ, অর্শ, ক্রিমি ও শ্বাসকষ্টের জন্যেও বেশ ভালো উপকারী। আকন্দের ফুল বহুমূত্ররোগ বা ডায়বেটিস এর জন্যে বিশেষ উপকারী বলে মনে করা হয়।
আকন্দ গাছের পরিচিতি ও প্রাপ্তিস্থান
আকন্দ গাছ দেখতে এক প্রকার গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। আকন্দ গাছ সাধারণত ৮ থেকে ৭ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয় থাকে। এই গাছের পাতা ৪ থেকে ৮ ইঞ্চি লম্বা উপরিভাগ হয়। দেখতে মসৃণ এবং নীচের দিক তুলোর মতো হয়। এ শাখা, গাছের পাতা ভাঙলে দুধের মত একধরনের সাদা আঠা বের হয়। সাদা বা বেগুনি বর্ণের ফুল হয়। আকন্দ গাছ দুই ধরনের হয়। একটি হচ্ছে শ্বেত আকন্দ অন্যটি লাল আকন্দ। তবে লাল আকন্দের ফুলের রং বেগুনি ও শ্বেত আকন্দের ফুলের রং সাদা হয়ে থাকে।
গাছের পাতা ছিড়লে কিংবা কান্ড ভাঙ্গলে দুধের মত কষ (তরুক্ষীর) বের হয়। ফল সবুজ, অগ্রভাগ দেখতে পাখির ঠোটের মত। বীজ লোম যুক্ত, বীজের বর্ণ ধূসর কিংবা কালচে হয়ে থাকে। এই আকন্দ গাছ বিভিন দেশে পাওয়া যায় যেমনঃ- ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, ভারত, চীন, পাকিস্তান ও নেপাল। বাংলাদেশের সর্বত্র অঞ্চলে পাওয়া যায়। তবে রাস্তার পাশে এবং পরিত্যক্ত স্থানে বেশি পাওয়া যায়।
বংশবিস্তার
আকন্দ গাছ ভারতে ও বাংলাদেশে উন্মুক্ত পতিত জমি বা রাস্তার পার্শ্ববর্তী স্থান এবং রেললাইনের ধারে ও গ্রামে কাঁচা রাস্তার পাশে জন্ম নেয়, বিশেষ করে শুকনো স্থানে সবচেয়ে ভালো জন্মে। আকন্দের বংশবিস্তার বেশির ভাগ দেখা যায় আঁশ ও বীজের মাধ্যমে হয়। চৈত্র মাসে প্রায় গাছের পাতা ঝরে কিন্তু এই গাছের পাতা ঝরে না, এর ফুল ফোটে ফাল্গুন ও চৈত্র মাসে।
আকন্দ পাতার বিশেষ কার্যকারিতাঃ
বায়ুনাশক, পাকস্থলীর ব্যথা ও হজমকারক
আকন্দ গাছের ঔষধি ব্যবহার
- আকন্দের ৫-৬ ফোঁটা আঠার সঙ্গে ৩ গ্রাম হলুদের গুঁড়ো মিশিয়ে গোসলের এক ঘন্টা আগে লাগালে ছুলি এবং মেচেতা রোগের উপকার হবে।
- ১৬ ফোঁটা আকন্দের আঠা, সমপরিমাণ তিল-তেল এবং এক ফোটা হলুদের গুঁড়ো মিশিয়ে মলম তৈরী করে রাতে ঘুমানোর আগে মাত্র একবার লাগালে নিশ্চিত চুলকানী সেরে যাবে।
- যদি কোন কারণে দেহের কোন অঙ্গ ফুলে যায়, তাহলে সে স্থানে প্রথমে আকন্দ পাতা দিয়ে ঢেকে এরপর কাপড়ে জড়িয়ে বেঁধে রাখলে দ্রুত্ব ফোলা কমে যায়।
- বিছে কামড়ালে প্রথমে ধারালো ব্লেড বা ছুরি দ্বারা বিছের হুল বের করে নিতে হবে। এরপর সে জায়গায় আকন্দের আঠার প্রলেপ দিলে নিশ্চিত উপশম হবে।
- কানের যন্ত্রনার ক্ষেত্রে আকন্দ পাতায় পুরনো গাওয়া ঘি মাখিয়ে সে পাতাকে আগুনে ভালভাবে সেঁকে নিয়ে পাতাকে নিংড়ে কানে দিয়ে তুলা দ্বারা কান বন্ধ করে রাখতে হবে। এভাবে মাত্র দুদিন প্রয়োগ করলেই যন্ত্রণার উপশম হবে।
- সামান্য সরিষার তেল ও আকন্দ গাছের আঠায় মিশিয়ে মালিশ করলে বাতের ফুলা ও যন্ত্রণা একই সাথে দুটোই দ্রুত্ব কমে যাবে।
- অজীর্ণে আকন্দের ফুলকে রোদে ভালভাবে শুকিয়ে তারপর গুঁড়ো করে প্রত্যহ দুপুরে ভাত খাওয়ার পর এক চামচ করে খেতে হবে। ঠান্ডা, কাশিতে ১ চামচ করে সকাল-সন্ধ্যায় মোট দু’বার খাওয়া দরকার।
- এই আকন্দ গাছের মূলের ছালকে ভালভাবে বেটে প্রলেপ দিলে একধরনের গোদ রোগে সেরে যায়।
- গৃহপালীত পশুপাখীর ক্ষেত্রে গরুর গলা ফুলা রোগে আকন্দ পাতা গরম করে অথবা আকন্দ পাতার সাথে অন্যান্য উপাদান পিষিয়ে আস্তরণ তৈরি করে গরুর গলায় ফুলে যাওয়া স্থানে লাগালে অনেক উপকার হয়।
আকন্দ গাছের চাষাবাদ
আকন্দ গাছ এর চারা বা কাটি রোপণের সময় ৩ থেকে ৪ ফুট দুরুত্বে লাগাতে হয়। এই আকন্দ গাছের আর্চয্য বিষয় হলো মে- জুন মাসে ফল পাকলে ফেটে বীজ বাতাসে ভেসে বেড়ায়। এই সময় এটি চাষ করা ভালো হয় ভালো। তখন সেই চারা নষ্ট হয় না। আবার কাটিং পদ্ধতিতেও এটি চাষ করা যায়। আকন্দের বীজ অনেক ছোট তাই প্রতি কেজিতে বীজের পরিমাণ প্রায় ১লক্ষ ৩৫ হাজার থেকে ১ লাখ ৪০ হাজারটি হয়।
বীজ সংরক্ষণ:
প্রাচীনকাল থেকে দেখা গিয়েছে আকন্দের বীজ থেকে বংশ বিস্তর সম্ভব হলেও সাধারণত এর শিখড় ও সাকার অংশ থেকে বংশ বিস্তার বেশি হয়ে থাকে। এই আকন্দ ব্যবহার্য অংশ গুলো হলোঃ পাতা, ফুল, শিকড় ও আঠা। এই গাছের ভেষজ গুণাগুন অনেক বেশি তাই এর সব কিছু সংরক্ষন করা হয়।
জমি নির্বাচন: আকন্দ গাছ প্রায় সব ধরনের মাটিতেই জন্মায়। তাই জমি নির্বাচন করতে তেমন কোন ঝামেলা হয় না।
জমি তৈরি: আকন্দ গাছ লাগানোর পূর্বে জমি ভালভাবে চাষ দিয়ে আগাছামুক্ত করে নিতে হবে। এরপর বীজ বপণ বা চারা রোপণের পূর্বে, বীজতলার মাটির সাথে বা গর্তের মাটির সাথে জৈব সার এই ৩ঃ১ অনুপাতে মিশাতে হবে। এতে করে বীজ ভালো জন্মাবে।
বীজ বপণ/চারা রোপণ: আকন্দের ফল পাকলে ফেটে যায় ও বীজ বের হয়ে বাতাসে ভেসে বেড়ায়। সেই সময় বীজ সংগ্রহ করে মাটিতেচাষ করলে চারা ভাল হয়।
পরিচর্যা:
(i) আগাছা পরিস্কার করতে হবে।
(ii) বিশেষ করে শুস্ক মৌসুমে পানি সেচের ব্যবস্থা করতে হবে।
(ii) আকন্দ গাছে সার না দিলেও চলে। কিন্তু প্রতি বছর ১৫-২০ কেজি জৈব সার দিতে হবে, দুই কিস্তিতে দিলে ভালো হয়ঃ –পথম কিস্তি মধ্য ফাল্গুন-মধ্য বৈশাখ মাসে এবং দ্বিতীয় কিস্তি মধ্য আশ্বিন-মধ্য অগ্রহায়ন মাসে প্রয়োগ করলে সবচেয়ে ভাল হয়। তবে গাছের বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে জৈব সারের পরিমাণ ১০% হারে বৃদ্ধি করতে হবে। এতে গাছ স্তেজ থাকবে।
আরও পড়তে পারেনঃ চিরতা খাওয়ার উপকারিতা ও ভেষজ গুনাগুন
সতর্কীকরণঃ
আকন্দ গাছের প্রায় সব অংশই বিষাক্ত। তাই আপনি ব্যবহারে সতর্ক হোন। তবে অতিরিক্ত ব্যবহারে ক্ষতি হবে। ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ঔষদ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।