পৃথিবীতে নানা ধরনের ফল রয়েছে তার মধ্যে হরিতকি একটি বিশেষ ফল। এই হরিতকী ফলের উপকারিতা অনেক বেশি থাকার কারণে প্রাচীন কাল থেকে এর ব্যবহার হয়ে আসছে। এই হরিতকির ফলের মধ্যে বিশেষ ধরনের গুনাবলি রয়েছে।
তবে, তিন ফলের সমন্যয়কে ত্রিফলা বলে ডাকে সেই তিনটি ফল হলো হরিতকী, আমলকী, ও বহেড়া। এই ফল ঔষধি হিসেবে ত্রিফলা স্বাস্থ্যের জন্য বহুমাত্রিক কার্যকরী ভূমিকা পালন করে থাকে। কিন্তু এই ফল কে আয়ুর্বেদিকে ত্রিফলাও বলে। এই ত্রিফলার স্বাদ তিতা। কিন্তু তিতা হলেও এর অনেক গুন রয়েছে।
আমাদের যদি এই গাছের উপকারিতা ও গুনাগুন সম্পর্কে জানা থাকে তাহলে অনেক রোগের কবল থেকে রাহাই পাওয়া যাবে। তাই আমাদের সকলের জানা দরকার এই ত্রিফলার গুনাবলি গুলো। তাহলে চলুন জেনে নেয়া যাক এই গাছের বিশেষ গুনাবলি গুলো। আরো জানবো এর বৈশিষ্ট্য চাষাবাদ পদ্ধতি।
হরিতকির বৈশিষ্ট্য সমূহ (Characteristics of chebulic myrobalan):
হরিতকির আদি নিবাস বাংলাদেশ ও ভারত। এর বৈজ্ঞানিক নাম টের্মিনেলিয়া চেব্যুলা তবে এটি একটি সপুষ্পক উদ্ভিদ। এই গাছের উচ্চতা ৩৫-৪০ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। হরিতকির গাছ বীজ থেকে সাধারনত গজাতে ১০-১৬ দিন সময় লাগতে পারে। এই গাছের ও পাতা ঝড়ে ফেব্রয়ারি-মার্চ মাসে। তবে পাতা ঝরার সাথে সাথে নতুন পাতা গজাতে শুরু করে। এই গাছের ছাক বা বাকল গাঢ় বাদামি হয়।হরিতকির পাতা লম্বা এবং চ্যাপ্টা, লম্বায় পাঁচ-ছয় ইঞ্চি হয়ে থাকে।
এর ফুল ফোটে ডালের শেষে এবং এর রং হালকা হলুদ ভাব কিছুটা সাদা রংগের ও হয়ে থাকে।এই ফলের আকার লম্বা ও মোচাকৃতি হয়। তবে কাঁচা ফলের রং হয় সবুজ এবং পরিপক্ব ফনলের রং হয় হালকা হলুদ ভাব। এই ফল শুকালে কালচে খয়েরি রং ধারণ করে। এই হরিতকির ফল শুকালে আবরন খুবই শক্ত হয়। এই ফলের আরেকটি বিশেষ গুল হলো শুকানোর পর সহজে নষ্ট হয় না। তাই এই ফল বছরের পর বছর থাকে ভালো। এই ফলের ত্বক বাইরে থেকে দেখতে কুচকানো। এই ফলের লম্বা পাঁচ-ছয়টি শিরা থাকে যা অন্য ফলের থাকে না।
হরিতকির ফল সংগ্রহ করা সময় ডিসেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত তবে এর পরেও করা যায়। অন্যন্য ফলের যেমন বীজ থেকে চারা তৈরি করা যায় তেমনি এই হরিতকির বীজ থেকে চারা তৈরি করা যাবে। এই ফলে বিভিন্ন ধরনের উপকারি উপাদান রয়েছে সেগুলো হলোঃ অ্যামাইনো অ্যাসিড, ট্যানিন ফ্রকটোজ, সাকসিনিক অ্যাসিড এবং বিটা সাইটোস্টেরল সমৃদ্ধ উপাদান। এই সপুষ্পক উদ্ভিদ ভারতের গ্রামাঞ্চলে বিক্ষিপ্তভাবে জন্মায়। এই গাছের কাঠ অনেক শক্ত হয়। তাই এর কাঠ আসবাপত্র তৈরি করতে ব্যবহার করা হয়।
হরিতকী ফলের উপকারিতা ও ব্যবহার (Herbal properties and uses):
উপরিক্ত আগেই বলা হয়েছে এই গাছের অনেক গুনাগুন রয়েছে আবারো বলা হলোঃ এই গাছের প্রত্যেকটা অংশ যেমন গাছের ফল,বীজ,পাতা, সব কিছুই মানুষের উপকার হয় ঔষধি হিসাবে। এই হরিতকি মানুষের বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক হিসেবে এই গাছ বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এই হরিতকী ভেজানো জল সব রোগের মহৌষধ হিসাবে কাজ করে এমন কি ব্যাকটেরিয়া ও ফাঙ্গাস জনিত রোগের ক্ষেত্রে বিশেষ কার্যকারিতা পালন করে থাকে। কেউ যদি হরীতকী ভেজানো পানি/জল নিয়মিত ব্যবহার করলে বিভিন্ন রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। হরতকির পুষ্টিগুন অনেক বেশি তাই আমাদের আরো জানা প্রয়োজন কোন কোন রোগের হাত থেকে দেহকে রক্ষা করতে পারে ও কার্যকারিতা পাওয়া যায়।
কোষ্ঠকাঠিন্য রোগ: এই রোগ খুবই মারাত্মক ও বেদনা দায়ক। এই রোগ হলে শরীর শুকিয়ে যায় রোগির খাওয়ার রুচি থাকে না। এই রোগ যদি কেউ সহজে না সারাতে পারে তাহে তার পর্বতীতে আরো বড় ধরনের সমস্যা দেখা দিবে। এই রোগ কে দ্রুত্ব সারাতে হতে। এই রোগ নিরাময়ের সহজ পদ্ধতি হলো হরিতকির ভেজানোর পানি পান করেন নিয়মিত দেখবেন কয়েক দিনের মধ্যে ভালো উপকার পাবনে।
এলার্জি রোগ: এই রোগ প্রায় লোকের হয়ে থাকে এলার্জি জনিত খাবারের কারনে। এই এলার্জি একটি বিরক্তিকর রোগ। এলার্জি বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে একধরনের এলার্জি হলো শরীর ফুলে যায় এবং চুল কায়। এই হরিতকি ভেজানো পানি খেলে সব ধরনের এলার্জি ভালো হয়ে যায়।
হজম ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে: যাদের হজম ক্ষমতার সমস্যা হয়। যখন আপনার খাবারের মধ্যে থাকা পুষ্টিগুণ ভাল ভাবে শরীরে মেশে না। এমন কি ভাল করে পাকস্থলী খাবার পরিপাক করতে না পারলে হজমে সমস্যা হয়। এই হজমের সমস্যা সমাধানের জন্য পাকস্থলীর যাবতীয় কাজ ঠিক ভাবে হওয়া দরকার। এই হরিতকী ঠিক এই কাজটিই করে। কেউ যদি দুপুরে আর রাতে খাবারের পর হরিতকী গুঁড়ো যদি অল্প উষ্ণ গরম জলে মিশিয়ে খেতে পারেন তাহলে খুব ভাল উপকার পাবেন। তবে এর ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য সমস্যাও কমবে।
রূপ সম্পর্কীয় সমস্যার সমাধানে: প্রত্যেক মানুষের শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি আমাদের ত্বক বা চুলের সমস্যায় যে হরিতকী ভাল কাজ করে তার আভাষ আগেই দিয়েছিলাম। তবে এবার কিছু দিক ধরে ধরে আপনাদের সঙ্গে আলোচনা করব কীভাবে হরিতকী আপনাকে চুল হোক বা ত্বক, বিভিন্ন সমস্যা থেকে মুক্তি দেবে।
হার্ট ভালো রাখতে হরিতকী: হরিতকী অন্যতম কাজ এই হার্টের ওপর। তবে হার্টের বেশ কিছু সমস্যা, উদাহরণস্বরুপ, হার্টবিট কম হওয়া, বুক ধড়ফড় করা, হাল্কা চিনিচিনে ব্যথা, তবে এইসবই হরিতকীর গুণে কমে আসতে পারে। এই হরিতকী হার্টের মাসল মজবুত করে, রক্ত সঞ্চালন আর পাম্পিং ক্ষমতা বাড়ায়। এর সঙ্গে কোলেস্টেরল হওয়ার মাত্রাও অনেক কমিয়ে আনে। তাই হার্ট অ্যাটাক, হার্ট ব্লক বা রক্ত জমাট বাধার মতো সমস্যা হওয়ার প্রাথমিক প্রবণতা অনেক কমে আসে। কিন্তু চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ তবে অবশ্যই করতে হবে বেশি সমস্যায় হলে।
আর্থ্রারাইটিস নিরাময়ে: বর্তমান শুধু বয়স্ক মানুষ নন, আজকাল অনেক কম বয়সের মানুষেরও হাঁটুর ব্যথা, গাঁটের ব্যথা এই সব হয়। তবে এই ক্ষেত্রে ওষুধ খাওয়ার পাশে হরিতকী যদি আপনি ব্যবহার করেন তাহলে তা হবে সোনায় সোহাগা। এই হরিতকীর মধ্যে ক্যালসিয়াম আছে প্রচুর পরিমাণে। কিন্তু ক্যালসিয়াম হাড় শক্ত করতে, টিস্যু মজবুত করতে সাহায্য করে। সুতরাং বোন টিস্যু, হাড় মজবুত হলেই ব্যথা, জয়েন্ট পেইন কম হবে। তবে হরিতকীর তেল, যে কোনও ভাল আয়ুর্বেদিক দোকানে বা অনলাইনে পাওয়া যায়, তা কিনে মালিশ করতে পারেন। তা না হলে বাড়িতেই তেল বানিয়ে নিন। হরিতকী ১০টা ফল নিয়ে আগে রোদে এক সপ্তাহ শুকিয়ে নিন। এরপর এই হরিতকী গুঁড়ো করে নিন। তারপর সর্ষের তেলের মধ্যে এই হরিতকী গুঁড়ো আর রসুন নিয়ে নেড়ে সেই তেল ঠাণ্ডা করে মালিশ করতে পারেন।
অ্যালজাইমার সমস্যা সমাধানে: অ্যালজাইমা হলো স্নায়ু বা নার্ভের সমস্যা। তবে অনেক সময়ে আমরা ভুলে যেতে থাকি অনেক কিছু। কিন্তু বয়স বাড়লে এটা আরও বেশি হয়। একে বুদ্ধিভ্রংশের সমস্যা বলা হয়। এটি স্নায়ু দুর্বল হলে অনেক সময়ে খিঁচ রোগ হয়, নানা রকম বিকৃতি দেখা যায়। কিন্তু এর সবের সমাধান আয়ুর্বেদিক মতে হরিতকী। আয়ুর্বেদিক মতে হরিতকী খেলে আমাদের স্মৃতিশক্তি বাড়ে। তখন আমরা অনেক বেশি মন দিয়ে শান্ত হয়ে কাজ করতে পারি। কেউ যদি হরিতকী চূর্ণ রোজ দুই বেলা হাফ চামচ করে খেলে সে উপকার অবশ্যই পাবে।
ডায়াবেটিস নিরাময়ে: এখনকার দিনে ডায়াবেটিস প্রায় মহামারীর পর্যায়ে চলে গেছে। ডায়াবেটিস প্রত্যেক ঘরে ঘরে আজ এই সমস্যা। ডায়াবেটিসকে আয়ুর্বেদ বলছে হরিতকী রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়ার সমস্যাতেও উপকারে আসে। তবে এর মধ্যে থাকা হাইপোগ্লাইকেমিক উপাদান শর্করার মাত্রা রক্তে ঠিক রাখে। এই হরিতকী ফল গ্লুকোজের অতিরিক্ত উৎপাদন হতে দেয় না, একটা ভারসাম্য বজায় রাখে। এর ফলে আমরা ডায়াবেটিসের সমস্যায় কম ভুগি।
সেক্সুয়াল হেলথ বৃদ্ধি করে: প্রাচীন যুগ থেকে আজকের প্রজন্ম, সেক্সুয়াল হেলথের দিকে কিন্তু নজর আলাদা ভাবে দিয়েছি সকলেই। তবে নারী ও পুরুষ, উভয়ের ক্ষেত্রেই হরিতকী সেক্সুয়াল হেলথ মজবুত করতে পারে। এটি স্ট্রেস কমিয়ে সেক্স হরমোন, মানে টেস্টোস্টেরন বা প্রজেস্টেরন হরমোনের নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করে, নিয়মিত নিঃসরণ বজায় রাখে। এর ফলে ‘সেক্স আর্জ’ বা চাহিদা তৈরি হতে থাকে।এই হরিতকী পুরুষের মধ্যে শক্তি, ক্ষমতা আর নারি-পুরুষ উভয়ের মধ্যেই উৎপাদন শক্তি অনেক বাড়ায়।
চুলের যত্নে হরিতকি: বর্তমান সময়ে ছেলে এবং মেয়ে উভয়ে চুল নিয়ে অনেক টেনশন করে থাকে। যার এই চুল নিয়ে অনেক টেনশনে আছেন। তাদের জন্য সুখবর কেননা এই প্রাকৃতিক গাছ চুলের জন্য অনেক উপকার করে থাকে। কেউ যদি হরিতকির গুড়ার সাথে নাঈকেল এর তেল মিশিয়ে মাথায় ব্যবহার করলে তার চুল পড়া বন্ধ হবে।
চুলের যত্ন করার সহজ উপকরণঃ ১ চামচ আমলা পাউডার, ২ চামচ হরিতকী পাউডার, হাফ চামচ বহেরা পাউডার আর হেনা পাউডার।
চুলের যত্ন করার সহজ পদ্ধতিঃ আপনি যেটা করবেন একটি পাত্রে সব উপকরণ নিয়ে পানি দিয়ে ভাল করে মিশিয়ে নিন। তারপর সপ্তাহে এক দিন চুলে এই মিশ্রণ ব্যবহার করে ১ ঘণ্টা রেখে দিন। এরপর ভাল করে ধুয়ে কন্ডিশনার ব্যবহার করে নিন। তারপর শ্যাম্পু আলাদা করতে হবে না। বরংচ চুল ফুরফুরে হবে এবং চুলের স্বাস্থ্য ভাল থাকবে।
ত্বকের যত্নে হরিতকির ব্যবহার: আমরা সবাই ত্বক ভালো রাখতে চাই তবে কয় জনে পারি। আপনি যদি ত্বক ভালো রাখতে চান তাহলে হরিতকির গুড়া পানিতে ভিজিয়ে রেখে নিয়মিত খেলে ত্বক ধীরে ধীরে উজ্জল হবে।
শিশুদের সর্দি নিরাময়ে: ছোট শিশুদের সর্দি হলে হরিতকির গাছের গুড়ার সাথে মধু মিশিয়ে খেলে সর্দি দ্রুত্ব সর্দি ভালো হয়।
চোখের রোগ: হরিতকি ফলের একটি গুণ হলো চখের নানা ধরনের কাজ করে থাকে। তবে আপনি চাইলে হরিতকির ভেজা পানি দিয়ে মুখ ধুলে চোখের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
ব্রণ কমাতে হরিতকি: যাদের ত্বক তেলতেলে তাঁদের ব্রণ খুবই হয়ে থাকে। কিন্তু ব্রণ কমে গেলেও ব্রণের দাগ সহজে যেতে চায় না। তবে হরিতকীর সাহায্যে এই ব্রণের দাগ দূর করা সহজে সম্ভব।
ব্রণের দাগ দূর করার সহজ উপকরণঃ ১ চামচ চন্দন বাটা, ১ চামচ কাঁচা হলুদ বাটা, ২ চামচ হরিতকী গুঁড়ো।
ব্রণের দাগ দূর করার করার সহজ পদ্ধতিঃ সব উপকরণ ভাল করে মিশিয়ে নিন। ব্রণ যে যে জায়গায় হয়েছে সেই সেই জায়গার ওপর দিয়ে রাখুন ৩০ মিনিট মতো। তারপর সাধারণ তাপমাত্রার জল দিয়ে ধুয়ে নিন। এটি এক দিন ছাড়া ছাড়া করুন খুব ব্রণর সমস্যা হলে। কম ব্রণ থাকলে বা ব্রণর দাগ কম থাকলে সপ্তাহে তিন দিন করলেই হবে। এক মাসের মধ্যে অনবদ্য ফল আপনার চোখের সামনেই থাকবে। হরিতকী আর হলুদ, এই দুইয়ের অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল প্রপার্টি ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ যাতে কম হয় তা দেখবে। চন্দন অতিরিক্ত তেলতেলে ভাবও কমাবে।
দাঁতের জন্য: হরিতকীর মধ্যে ক্যালসিয়াম আছে আগেই বলেছিলাম। কিন্তু আমাদের দাঁত তো ক্যালসিয়াম দিয়েই তৈরি। সুতরাং হরিতকী ব্যবহার করলে দাঁতের বেশ কিছু সমস্যা অনায়াসেই দূর হয়ে যায়। যদি আপনার দাঁতে গর্ত হলে বা ক্যাভিটি হলে কি করবেন সেই আলোচনায় আসি।
যদি দাঁতে গর্ত হয় ডাক্তার তো অবশ্যই দেখাতে হবে। তবে কিন্তু ব্যথা যে হয় সেটা প্রাথমিক ভাবে হরিতকী ব্যবহার করে কমিয়ে আনা সম্ভব। এর জন্য হরিতকী দিয়ে একটা পেস্ট বানাতে হবে। পথমে হরিতকী রোদে শুকিয়ে গুঁড়ো করে তার মধ্যে অল্প পনি মিশিয়ে একটি ঘন পেস্ট তৈরি করুন। যদি ব্যথা হয় বা চিনচিন করে ওই গর্তের জায়গায় এই পেস্ট অল্প দিয়ে রেখে দিন। দেখবেন ধীরে ধীরে দেখবেন ব্যথা কমে আসছে।
দাঁত পরিষ্কার রাখতে: অনেকের দাঁতে হলদে হলদে ছোপ ছোপ পড়ে যাওয়া। তবে অনেক কিছু করেও এর থেকে সহজে মুক্তি মেলে না। আপনি হরিতকী একবার ব্যবহার করে দেখুন। যদি হরিতকী গুঁড়ো দিয়ে শুধু দাঁত মাজতে পারেন। এটা করলে সবচেয়ে ভাল হয়। তা না হলে আপনি যে মাজন ব্যবহার করেন তার সঙ্গে হরিতকী গুঁড়ো মিশিয়ে নিন। আপনি রোজ যে পেস্ট দিয়ে দাঁত মাজেন। সেই মাজন দুই থেকে তিন সপ্তাহ ব্যবহার করে দেখবেন দুই থেকে তিন সপ্তা মধ্যে দাঁত অনেকটা সাদা হয়ে আসবে।
মূখে ছিদ্র হ্রাস করে: যাদের মুখে বড় বড় ছিদ্র দেখা যায়। মনে হয় খুব জোরে জোরে স্ক্রাব করার জন্য বা কিছু জিনিস মুখে মাখার জন্য এতো বড় ছিদ্র হয়ে গেছে। কিন্তু এর থেকে হরিতকী উপকার করবে। ছিদ্র বা মুখের ছিদ্র কমিয়ে আনবে এই পেস্ট।
মূখে ছিদ্র হ্রাস করার সহজ উপকরণঃ হাফ চামচ বেসন, হাফ চামচ মুলতানি মাটি, ১ চামচ হরিতকী পাউডার, ১ চামচ গোলাপ জল।
মূখে ছিদ্র হ্রাস করার সহজ পদ্ধতিঃ হরিতকীর সব উপকরণ ভাল করে মিশিয়ে একটা ঘন পেস্ট তৈরি করে নিন।পানি দেবেন না, শুধু গোলাপ জল দিয়ে গুলবেন। তারপর এই পেস্ট মুখে মেখে ৩০ মিনিট অপেক্ষা করুন। এরপর সাধারণ পানি দিয়ে ধুয়ে নিন। সপ্তাহে দু দিন ব্যবহার করুন আর একমাস টানা ব্যবহার করুন। অনেক উপকার পাবেন আপনি।
ডার্ক সার্কেল নিরাময়ে: অনেকেই চিন্তা বেশি করে বা নিয়ম করে না ঘুমিয়ে এই অবস্থা। এর চোখের কোলে কালি আমাদের সৌন্দর্য নষ্ট করে দেয়। তবে এর জন্যও হরিতকীর বিশেষ প্রয়োগ আছে।
সহজ উপকরণঃ হাফ চামচ অ্যালোভেরা জেল, ১ চামচ হরিতকী গুঁড়ো, ২ ফোঁটা আমন্ড অয়েল।
সহজ পদ্ধতিঃ হরিতকীর সব উপকরণ মিশিয়ে মোটামুটি ঘন একটা পেস্ট বানান। এরপর চোখের নিচের অংশে লাগিয়ে সার্কুলার মোশনে ম্যাস্যাজ করুন হালকা করে। এর ১৫ মিনিট রেখে দিন শুকিয়ে যাওয়ার জন্য। এর ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে নিন। আপনি সপ্তাহে তিন দিন করুন খুব ভাল ফল পাবেন।
হরিতকী এতো গুণসম্পন্ন কেনো:
এই হরিতকীর মধ্যে থাকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি আর সেলেনিয়াম, ম্যাংগানিজ, আয়রন, কপারের মতো খনিজ। তবে এর ফলে আমাদের চুলের সার্বিক স্বাস্থ্য বজায় রাখতে হরিতকীর অবদান অনেক। হরিতকী থেকে যে তেল পাওয়া যায় তা আমাদের গ্যাসের সমস্যা থেকে দারুণ ভাবে মুক্তি দেয়। এমন কি মলের অনিয়ম বা কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে দেয়। এই হরিতকীর পাউডার বা গুঁড়ো অ্যান্টি-অক্সিডেন্টে ভরপুর থাকে, যার ফলে আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বেড়ে যায়। কখনো কোনো ক্ষত হলে সেখানে হরিতকীর গুঁড়ো একটু নারকেল তেলের সঙ্গে মিশিয়ে ব্যবহার করলে দ্রুত্ব উপকার পাওয়া যায়। তবে এই সব গুণ রয়েছে এক হরিতকীর মধ্যে।
হরিতকী খাওয়ার নিয়ম:
হরিতকী খাবার কিছু নিয়ম আছে। সেই নিয়ম মেনে যদি খান তাহলে কাজ হবে অনেক ভাল। হরিতকী আপনি চূর্ণ বা গুঁড়ো রূপে, কাথ হিসেবে আবার বড়ি হিসেবেও খেতে পারেন। কিছু জিনিসের সঙ্গে মিশিয়ে হরিতকী খেতে হয় মরসুমের সঙ্গে তাল রেখে। গরমের সময়ে হরিতকী খেলে অল্প গুড় মিশিয়ে খান। আবার বর্ষার সময়ে হরিতকী রক সল্ট আর শরতে চিনির সঙ্গে খেলে ভাল উপকার পাবেন। শীতের শুরুতে অল্প আদা কুচি আর শীতের মধ্যে অল্প গোলমরিচ দিয়ে হরিতকী খেতে পারেন। আর বসন্তকালে মধু দিয়ে হরিতকী খাওয়া সবচেয়ে উপকারী। আর প্রত্যেকবার হরিতকী খাওয়ার পর খানিক উষ্ণ জল খেতে হবে।
হরিতকীর ক্ষতিকর দিক বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া:
- হরিতকীর অনেক গুণের কথাই তো বলা হয়েছে। যার এতো এতো গুণ আছে সেই হরিতকীর কিন্তু আবার কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও আছে। উদাহরণস্বরূপ, ধরুন খুব বেশি পরিমাণে হরিতকী খেলে আপনার ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে। আবার রোজ যদি হরিতকী খান তাহলে সর্দি-কাশি কমার বদলে বরং বেড়ে যেতে পারে।
- হরিতকী গর্ভাবস্থায় খাওয়া একদমই উচিত নয়। যদি হরিতকী খাওয়ার পর অল্প উষ্ণ পানি না খেলে সেই হরিতকী সহজে হজম হতে চায় না। আবার তখন হজম না হওয়া হরিতকী বিপরীত ফল দিতে শুরু করে। সুতরাং বারবার করে বলা হয়েছে হরিতকী যে কোনও রূপে খাবার পরই অল্প উষ্ণ পানি খেয়ে নিতে হবে।
- আর হরিতকী কখনই শুধু শুধু কোনও কাটা বা আঘাত লাগা জায়গায় দিতে নেই। সবসময়ে অন্য কিছু, খুব ভাল হয় অল্প নারকেল তেল সহযোগে যদি সেই আঘাত লাগা জায়গায় ব্যবহার করা যায়।
- সুতরাং আমরা এই প্রতিবেদনে সেরকম ভাবেই ব্যবহার করতে বলেছি। তবে যে যে জিনিসের সঙ্গে মিলিয়ে খেতে বলা আছে হরিতকী ঠিক সেই সেই জিনিসের সঙ্গে মিশিয়ে খান সময় অনুযায়ী।
- সর্বশেষ মূল কথা হল বেশি পরিমাণে হরিতকী ব্যবহার করাই আসলে খারাপ। তাই সবসময় পরিমাণ ঠিক রেখে অল্প অল্প করে বেশ টানা কিছু দিন হরিতকী ব্যবহার করলে তবেই উপকার পাওয়া যাবে।
- দ্রুত উপকার পাওয়ার জন্য একবারে অনেকটা ব্যবহার করলে লাভের বদলে ক্ষতিই বেশি হবে।
ত্রিফলা:
ত্রিফলা অর্থাৎ হরিতকি, আমলকি ও বহেরা এর প্রতিটির সমপরিমাণ গুঁড়ার শরবত কোলেস্টেরল কমাবার অর্থাৎ প্রেসার বা রক্তচাপ কমাবার এক মহৌষধ। এই ঔষুধ গবেষক দলের মতে, আধুনিক যে কোন এ্যালোপ্যাথিক ঔষধের তুলনায় ত্রিফলা কোলেস্টেরল মাত্রা কমাবার ক্ষেত্রে অনেক বেশি ফলপ্রসূ/ ভূমিকা রাখে।
বাংলাদেশে ভেষজ উদ্ভিদের বর্তমান অবস্থা ও গুরুত্ব (Current status and importance of medicinal plants in Bangladesh):
সর্বমোট ভেষজ উদ্ভিদের সংখ্যা কত? বাংলাদেশে তা নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত তালিকাভুক্ত ভেষজ উদ্ভিদের সংখ্যা ৫৪৬টি উল্লেখ করা হলেও প্রকৃতপক্ষে এ সংখ্যা বহুগুণ বেশি। কেননা বাংলাদেশে অধিকাংশ উদ্ভিদ ও লতা-গুল্মেরই ভেষজ গুণ রয়েছে। প্রত্যেকের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার্য সবজি ও মসলাজাতীয় সবগুলো উদ্ভিদই উচ্চমাত্রার ভেষজ গুণসম্পন্ন।
বাংলাদেশে ভেষজ উদ্ভিদের ব্যবহার(Use of medicinal plants in Bangladesh) :
আমাদের বাংলাদেশে বার্ষিক কী পরিমাণ ভেষজ উদ্ভিদ ব্যবহৃত হয় তার কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৩ শতাধিক ইউনানী ও ২ শতাধিক আয়ুর্বেদিক ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তবে এ ছাড়াও রয়েছে বহু ভেষজ প্রসাধনী প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। এই সব প্রতিষ্ঠানে বছরে ২০ হাজার টনেরও বেশি ভেষজ কাঁচামালের চাহিদা রয়েছে বলে জানা যায়। তবে বাংলাদেশে প্রতি বছর সাড়ে ৩০০ থেকে পৌনে ৪০০ কোটি টাকার ভেষজ সামগ্রী আমদানি করা হয়। সাধারণত এগুলো ভেষজ ওষুধ ও প্রসাধন সামগ্রী তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
ঔষুধ এবং ভেষজ প্রসাধনী তৈরির কারখানা অনেক বেড়েছে, এর সঙ্গতকারণে উল্লিখিত ভেষজের চাহিদাও বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তা ছাড়া শহরে এবং গ্রামে অলিতে-গলিতে বিক্রি হয় এই ভেষজ উদ্ভিদ। তবে সমগ্র বাংলাদেশে বিভিন্ন কবিরাজ, টোটকা চিকিৎসকী এবং উপজাতি এবং আদিবাসী সমপ্রদায় প্রতিদিন ব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ ভেষজ উদ্ভিদ, যার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। এর বাইরেও অনেক ধরনের ভেষজ উদ্ভিদের চাহিদা রয়েছে উল্লিখিত শিল্পগুলোতে।
বাংলাদেশে অনায়াসে চাষাবাদযোগ্য কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ও লাভজনক ভেষজ উদ্ভিদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে-অর্জুন, অশোক, আতা, ডালিম/আনার, আমলকী, কুটজ/কুরচি, কয়েতবেল/কটফল, কাঁঠাল, কাগজি লেবু, কাঞ্চন, কামরাঙা, কুচিলা, খয়েরখদির, গনিয়ারী, গাব, গামার/গাম্বারী, গোড়া লেবু/জামির, চন্দন, চাপা/চম্পক, চালতা, চালমুগরা, ছাতিম, জয়ন্তী, জাম, তেজপাতা, তেঁতুল, দার্বচিনি, ধাইফুল,, মহুয়া, রক্ত চন্দন, র্বদ্রাৰ, রোহিতকা, শিমুল, সোনা, সজনে, সোনালু, হরিতকি, আগর/অগুর্ব, কর্পুর, ঘোড়ানিম, নাগেশ্বর, অনন্তমূল, আঙুর, আত্মগুপ্তা/ আলকুশী, গন্ধভাদুলে, গুড়ুচী, গুলঞ্চ, চই, পটল, পূর্ণনবা, ভৃঙ্গরাজ, শতমূলী, নিম, নিশিন্দা, পলাশ, পার্বল, পেয়ারা, বহেরা, বাতাবি লেবু, বেল, অর্শ্বগন্ধ্যা, এরন্ড, ওলোট কম্বল, কালকাসুন্দে, কালমেঘ, গোলাপ, ঘৃতকুমারী, চিতা (সাদা/লাল), সর্পগন্ধ্যা, জবা, তুলসী, বলা, বামুনহাটি, বাসক, বাবুই মেহেদী, শালপনি, তোকমা এই সবই চাষ যোগ্য।
বাংলাদেশে ভেষজ উদ্ভিদ চাষের অর্থনৈতিক গুরুত্ব (Economic importance of cultivation of medicinal plants in Bangladesh):
বাংলাদেশে ভেষজ উদ্ভিদ চাষ অন্য যেকোনো ফসল চাষের চেয়ে বহুগুণ বেশি লাভজনক ও নিরাপদ। তবে সমগ্র বিশ্বে ভেষজ উদ্ভিদের বিপুল চাহিদা রয়েছে। চীন ভেষজ উদ্ভিদ রপ্তানি করে প্রতি বছর আয় করে ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ভারত আয় করে ৬ বিলিয়ন ডলার ও দক্ষিণ কোরিয়ার আয় ২.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর শতভাগ রপ্তানি সম্ভাবনা ছাড়াও ভেষজ উদ্ভিদের চাষ করে কৃষক তুলনামূলক অধিক লাভ করতে পারেন। তবে এর অধিকাংশ ভেষজ উদ্ভিদের চাষ প্রক্রিয়া অত্যন্ত সহজ। এসব ভেষজ উদ্ভিদ চাষের ৰেত্রে সার ও কীটনাশকের ভূমিকা অত্যন্ত গৌণ, এ কারণে কৃষকের উৎপাদন খরচ তুলনামূলকভাবে অনেক কম। এই গুল্মজাতীয় ভেষজ প্রায় বিনা পরিচর্যা ও বিনা খরচে উৎপাদন সম্ভব, অথচ এসব উদ্ভিদের বাজারদর বেশ চড়া হয়।
আরো পড়ুনঃ আমলকির উপকারিতা ও ঔষধি গুনাগুন
আমরা জানি যে ত্রিফলা ফলের মধ্যে হরিতকি একটি বিশেষ ফল। এই ফলের ভেষজ গুনাগুন যেমন অধিক তেমনি এর অর্থনৈতিক মূল্য অনেক বেশি। এই ফল ভারতের এবং বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলেই পাওয়া যায়। এই মানব জাতির জন্য উপকারী একটি ফল। তবে আমরা আসা করি আজকের প্রতিবেদন আপনাদের উপকারে আসবে। যা সাধারণত আমরা খুব কম টাকায় দোকান থেকে হরিতকী কিনে আনি। কিন্তু হরিতকির শুধু উপকার জেনে তো হবে না। এবার আমাদের বলা কথাগুলো মেনে হরিতকী ব্যবহার করা শুরু করুন আর উপকার পেতে থাকুন।