আমাদের চার পাশে অনেক ঔষধী গাছগাছলা রয়েছে, তার মধ্যে শতমূলী খাওয়ার উপকারিতা অনেক বেশি। । শতমূলী একটি লতানো ভেষজ উদ্ভিদ। এই ভেষজ উদ্ভিদের গোড়ায় একগুচ্ছ কন্দ মূল থাকে। তবে এই শতমূলী খাওয়ার উপকারিতা অনেক রয়েছে। বিশেষ করে এই মূলগুলোই শতমূলী নামে বেশি পরিচিত। এই শতমূলীর মূলে লতায় বাঁকা কাঁটা হয়। এই শতমূলীর শরতে এর ফুল ও ফল হয়, এই ফল পাকে মাঘ-ফাল্গুন মাসে।
এই ফল দেখতে ছোট মটরের মত সবুজ ফল, তবে পাকলে লাল হয়। এই শতমূলীর ভেষজ গুণাবলি অপরিসীম কার্যকারি ভূমিকা পালিন করে। তবে এই গাছের প্রচলিত নাম: শতমূলী ও ইউনানী নাম: সাতাওয়ার এবং আয়ুর্বেদিক নাম: শতাবরী এই শতমূলী এর ইংরেজি নাম: Asparagus, বৈজ্ঞানিক নাম: Asparagus racemosus Willd, এটি Liliaceae পরিবারের অন্তরভূক্ত উদ্ভিদ।
শতমূলীর গুনাগুন ও কার্যকারিতা:
শুক্রগাঢ়কারক, বলকারক, স্তন্যদুগ্ধবর্ধক, স্বপ্নদোষ, মূত্রকৃচ্ছতা, শারীরিক দুর্বলতা, গনোরিয়া এবং শুক্রমেহে উপকারী।
- রাসায়নিক উপাদান: গ্লাইকোসাইড ও মূলে শর্করাদ্রব্য এবং পাতায় স্যাপোনিন বিদ্যমান।
- বিশেষ কার্যকারিতা: বলকারক, স্তন্যদুগ্ধবর্ধক, শুক্রগাঢ়কারক।
- শতমূলী ব্যবহার্য অংশ: শতমূলী গাছ এর কন্দমূল।
শতমূলী খাওয়ার উপকারিতা ও ব্যবহার
(ক)আপনি কি আমাশায় ভূকছেন? যদি আমাশা হয়ে থাকে তাহলে শতমূলীর মূলের রস ৩-৪ চা চামচ ৩ থেকে ৭ দিন প্রতিদিন সকালে ও বিকালে সেবন করলে আমাশা ভালো হয়ে যাবে। শতমূলী আমাদের অন্ত্রের কৃমি দূর করতে কাজ করে, এমন কি অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল হিসেবেও কাজ করে। তারপর শতমূলী মূলর রস আমাদের যকৃত এবং পিত্ত থলির নানা ইনফেকশন রোধে বিশষ ভাবে কাজ করে।
(খ) অনেকেই স্নায়ুশক্তি দূর্বলতায় ভূগেন তাদের জন্য এই শতমূলী স্নায়ুশক্তি বৃদ্ধি ও শারীরিক দুর্বলতা কাটাতে শতমূলী অনেক কার্যকর ভূমিকা রয়েছে। শারীরিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে শতমূলীর রস ৩-৪ চামচ নিয়ে ১ গ্লাস দুধের সাথে মিশিয়ে সকাল ও বিকেলে আহার করুন। এই শতমূলী ১০-১৫ দিন আহার করলে পুনরায় শক্তি ফিরিয়ে পাবে। এটি আরও অনেক রোগের কাজ করে থাকে যেমন যৌন দূর্বলতা ও শারীরিক দূর্বলতা,মহিলাদের সাদা স্রাব এসব সমস্যায় এর ৩-৪ গ্রাম পরিমান মূলচুর্ণ ১কাপ গরম দুধের সাথে মিশিয়ে দিনে দুবার পান করলে অসাধারণ উপকার পাওয়া যায়।
(গ) শতমূলীর আমাদের উচ্চ কিংবা নিন্ম উভয় ধরনের রক্ত চাপকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে অনেক সহায়তা করে। শতমূলীর খেলে এতে থাকা পটাসিয়াম এবং বেশ কিছু উপকারী খনিজ উপাদান আমাদের রক্ত চাপ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
(ঘ)অনেকের হজমের সমস্যা থাকে তাদের জন্য এই শতমূলী। এই গাছ আমাদের অসাধারণ হজমশক্তি র্বদ্ধি করে এবং বায়ু নিঃসরণে এটি দারূন কাজ করে। এই শতমূলীর ফল অল্প পরিমাণ তরকারি রান্না করে খেতে হয়। এটি বাত-ব্যাথা ও স্নায়ু দুর্বলতায় কার্যকারিতা রয়েছে। এই শতমূলীর ছালের রসের সাথে রসুন পিসে একসাথে মিশিয়ে প্রলেপ দিলে ব্যাথা সেরে যায়।
(ঙ)এই শতমূলী বিভিন্ন রোগের কাজ করে, দুর্বলতা,অ্যাসিডিটি, শারীরিক ব্যথা, ডায়রিয়া, আমাশয় ও শরীরের বিভিন্ন প্রকার প্রদাহ দূর করতে শতমূলী অনেক কার্যকর রয়েছে। সুতরাং এর শিকড় মানুষের কিডনি, লিভার, ও গনোরিয়ার জন্য অনেক উপকারী। বিশেষ করে এটি আমাদের নার্ভের কার্যক্ষমতা ঠিক রাখে এবং চোখ ও রক্তের যেকোনো সমস্যা দূর করে সহেতা করে।
শতমূলীর চাষ পদ্ধতি
শতমূলীর চাষ করতে চাইলে এর বংশবিস্তার বারাতে হবে। এ জন্য প্রধান মাধ্যম হলো বীজ। তবে সাকারের বা পার্শ্বের ডগা সাহায্যেও করা যায়। তবে এটি অনেক ব্যয়বহুল বলে বীজ থেকে বংশবিস্তার করাই উত্তম। এই শতমূলী বীজ বপন এপ্রিল-মে মাসে করলে সবচেয়ে বেশি ফল পাওয়া যায়। যখন চারার বয়স ২-৩ মাস হয় তখন বীজতলা থেকে নিয়ে তা রোপণ করতে হয়।
বীজ বপন পদ্ধতি:
এই শতমূলীর চাষ করা অনেক টা সহজ। তবে এর বীজ সংগ্রহের ২০-৩০ দিনের মধ্যে বপন করতে হয়। তবে শতমূলীর বীজ দুই পদ্ধতিতে এর বীজ বপন করা যায়।
1. চারা উত্তোলন পাত্র: এই শতমূলীর বীজ মাটি ও গোবর সার ৩:১ অনুপাতে মিশিয়ে এরপর মিশ্রণটি ছাঁকুনি দিয়ে ঢেলে চারা উত্তোলন পাত্র ভরতে হয়। তারপর চারা উত্তোলন পাত্র সারি করে বীজতলায় সাজিয়ে রাখা হয়। এরপর প্রতিটি বীজ উত্তোলন পাত্রে ২-৩টি বীজ সরাসরি বপন করতে হয়।
2. বীজতলায় সরাসরি বীজ বপন: শতমূলী বোপনের জন্য পর্যাপ্ত সূর্যের আলো পড়ে এমন উঁচু জায়গা বীজতলার জন্য নির্বাচন করতে হয়। তবে বীজতলা তৈরির জন্য ১ লিটার লম্বা এবং প্রয়োজন মতো দৈর্ঘ্যের জমি নির্বাচন করে মাটি সুন্দর ভাবে কুপিয়ে বীজতলা তৈরি করতে হয়। কিন্তু দুই বীজতলার মাঝে মিনিমাম ৩০ সেন্টিমিটার দূরত্ব বা ফাকা রাখতে হয়।
সেই মাটি উভয়দিকে তুলে বেড তৈরি করা হয়, যাতে পানি না জমে। তবে বীজতলার মাটির সাথে পরিমাণমতো গোবর (৩:১) মিশিয়ে অবশ্যই দিতে হবে। বীজ বোপনের আগে ২৪ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। এরপর বীজ বপনের পরে পলিথিন বা খড়কুটো দিয়ে ঢেকে রাখলে দ্রুত সেই বীজ গজাতে সহায়তা করে। পানির প্রয়োজন হলে ঝরনা দিয়ে বীজতলায় পানি ছিটিয়ে দিতে হবে।
অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা:
এই শতমূলীর বীজের আবরণ খুব শক্ত বিধায় অঙ্কুরোদগম হতে মিনিমাম ২০-২৫ দিনের মতো সময় লাগে।কিন্তু বীজ বপনের আগে মিনিমাম ২৪ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখলে ভালো হয়। অথবা শিরিষ কাগজ দিয়ে সাবধানে ঘষে অথবা পাকা মেঝেতে ঘষে বীজের ওপরের যে শক্ত আবরণ থাকে তা তুলে নিলে বীজ তাড়াতাড়ি গজায় সহেতা করে থাকে।
বাগান সৃজন ও পরিচর্যা
(i)চারা রোপণ পদ্ধতি: প্রথমে রোপণের জন্য নির্বাচিত জমি অবশ্যই আগাছামুক্ত করতে হবে। এরপর রোপণের আগে ৩০x৩০x৩০ সেন্টিমিটার আকারে গর্ত করে ভালোভাবে মেশানো পচা গোবর/কম্পোস্ট ও মাটি দিয়ে ভরাট করে ৭ দিন রেখে দিতে হয়। পরে ঐ মিশ্রণ টি ২-৩ দিন পরে আবার উলট-পালট করে চারা রোপণ করতে হয়। এভাবে বীজ বোপন করলে ভালো হয়। যদি বীজতলায় বা পাত্রে উত্তোলিত চারা জুলাই-আগস্ট (আষাঢ়-শ্রাবণ) মাসে রোপণ করতে হবে। রোপন করা হলে রোপিত প্রতিটি চারার গোড়ায় একটি করে কাঠি দিয়ে বেঁধে দিতে হবে। তাহলে চারা গুলো বাতাসে হেলে পড়বে না।
(ii) পরিচর্যা: যদি কেউ মাঠে চাষ করে থাকে তাহলে, সেই মাঠে রোপিত চারা গবাদিপশুর আক্রমণ থেকে অবশ্যই রক্ষা করতে হবে। বিশেষ করে আগাছা দেখামাত্র তা পরিষ্কার করতে হবে। তবে চারার গোড়ার মাটি কুপিয়ে আলগা করে দিতে হবে। কিন্তু বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে যাতে শেকড় কাটা না যায়। আবার এটিও খেয়াল রাখতে হবে, যেনো গোড়ায় পানি না জমে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে এবং শুষ্ক মৌসুমে প্রয়োজনে সেচ দিতে হবে। সেচ দিলে ভালো হয়।
(iii) ফসল সংগ্রহ, শুকানো ও সংরক্ষণ পদ্ধতি: এই শতমূলী চারা রোপণের ২ বছর বয়স থেকেই কন্দ সংগ্রহ করা যায়। তবে জমি থেকে খুব সাবধানে খুঁড়ে কন্দ তুলতে হবে যাতে তোলার সময় ছিঁড়ে না যায় এই দিকে খেয়াল রাখতে হবে। এই শতমূলী উঠিয়ে মূলগুলো কেটে পানি দিয়ে ভালোভাবে পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন করে রৌদ্রে শুকিয়ে চটের বস্তায় রাখতে হয়।
তবে মাঝে মধ্যে রোদে শুকাতে হয়, যাতে ছত্রাক জন্মাতে না পারে। তবে ছত্রাক জন্মীলে কন্দ এর মান কমে যায়। এই শতমূলী শুকনো অবস্থায় ১ বছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায় এবং এর কার্যকারিতা অটুট থাকে। তবে এটি একইভাবে বাজারজাতকরণ করা যায়।
(iv) ফলন: এই শতমূলীর গাছ ২ বছর থেকে ২.০-২.৫ কেজি কন্দ পাওয়া যায়। বিশেষ করে জমিতে চারা রোপণের ২ বছর পর থেকে কন্দ সংগ্রহ করা যায়। তবে সব কন্দ সংগ্রহ না করে গাছ বাঁচিয়ে রাখলে প্রতি বছরই সেখান থেকে কন্দ সংগ্রহ করা যায় এবং পরের বছরগুলোতে আরও অধিক পরিমাণে কন্দ পাওয়া যায়।
পাহাড়ে বাণিজ্যিক শতমূলীর চাষের সম্ভাবনা
এই শতমূলীকে বীজ হিসেবে কাজে লাগিয়ে পাহাড়ে বাণিজ্যিকভাবে উত্পাদন করা যাবে। সুতরাং পাহাড়ের রাবার বাগানসহ বিভিন্ন বাগানে অন্যান্য গাছের ফাঁকে শতমূলী চাষ করা সম্ভব। আয়ুর্বেদ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সাহাব উদ্দিন এমনটি মনে করেন।
তবে বাংলাদেশর বন ও গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্মকর্তা ড. রফিকুল হায়দার জানান, যে সমতল এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে উত্পাদিত শতমূলীর চেয়ে পাহাড়ে প্রাকৃতিকভাবে উত্পাদিত শতমূলীর ঔষুধি গুণাগুণ হাজার গুন বেশি। যদি সেগুলো চাষ না করে, শুধু আহরণ করতে থাকলে এক সময় দেখা যাবে বীজ হারিয়ে গিয়েছে। আরও তিনি বলেন যে, পাহাড়ে প্রাকৃতিকভাবে উত্পাদিত যে পরিমাণ শতমূলী বিক্রি হচ্ছে তা ভালো সংবাদ উল্লেখ করে। ‘তবে তিনি আরও বলেন যে, সংরক্ষণ করে চাষের ব্যবস্থা না করলে মূল্যবান উদ্ভিদটি এক সময় আর পাওয়া যাবে না। তাই বাণিজ্যিকভাবে চাষ হলে স্থানীয়দের ব্যাপক আর্থিক সফলতাও আসবে।’
শতমূলী কোথায় পাওয়া যায়
এই শতমূল বা শতমূলী ভারতীয় উপমহাদেশসহ উষ্ণ ও নাতিশীতোষ্ণ এলাকা শতমূলের আদি নিবাস। তবে এটি বাংলাদেশের সর্বত্র কম বেশি পাওয়া যায়। বিশেষ করে উত্তর পূর্বাঞ্চলের বনাঞ্চলে ও শালবনে বেশি পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন: রোগ নিরাময়ে অশ্বগন্ধা গাছের উপকারিতা ও ভেষজ গুণাবলি