বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালে সাধারণ বীমা (Insurance) ও জীবন বীমা (Life insurance) কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বীমা খাতের শুরু হলেও আজই অর্থাৎ পয়লা মার্চ প্রথমবারের মত জাতীয় বীমা দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে।
দেশের প্রায় পৌনে দুই কোটি মানুষ বিভিন্ন ধরনের বীমার আওতায় রয়েছেন, যদিও অনেকে বীমা সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা পোষণ করেন না। তবে অর্থনীতি বিশ্লেষকেরা বলেন, বীমা একজন বিনিয়োগকারীর ভবিষ্যতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে, একই সঙ্গে তার ঝুঁকিও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ভাগাভাগি করে নেয়া হয়।
বীমা মূলত কী?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক হাসিনা শেখ বলেছেন, ‘বীমা হল নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে জীবন, সম্পদ বা মালামালের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি কোন প্রতিষ্ঠানকে স্থানান্তর করা।’ এর মাধ্যমে ব্যক্তি বা বীমা প্রতিষ্ঠান অর্থের বিনিময়ে বিনিয়োগকারীর আংশিক অথবা সমস্ত সম্ভাব্য ঝুঁকি গ্রহণ করে থাকে।
হাসিনা শেখ আরো বলেন, “বীমা এক ধরনের বিনিয়োগ। এর মানে হচ্ছে আপনি ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার কথা ভেবে এখন একটি নির্দিষ্ট অর্থ জমা রাখছেন, নির্দিষ্ট সময়ের পর আপনি আপনার অর্থ হাতে পাবেন। এটা আপনার ঝুঁকি আরেকজনের সঙ্গ ভাগাভাগি করে নেয়ার মতো।”
তিনি আরো বলেন, “সহজ কথায় বলতে গেলে, এটি ভবিষ্যতের সম্ভাব্য ক্ষতির হাত থেকে নিজেকে সুরক্ষিত করার জন্য অর্থ প্রদানের মতো।”
উদাহরণ সরূপ: ধরা যাক, হেলথ ইনস্যুরেন্স বা স্বাস্থ্য বীমার কথা, যেখানে নিজের স্বাস্থ্য পরিস্থিতির বিপরীতে আপনি নির্দিষ্ট পরিমান অর্থ জমা করছেন, উদ্দেশ্য হচ্ছে যদি আপনার কোন দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে ঐ বীমা প্রতিষ্ঠান আপনার স্বাস্থ্য ব্যয়ের একটি অংশ বা একটি বড় অংশ প্রদান করবে। এই যে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ আপনি জমা রাখছেন, একে বলা হয় প্রিমিয়াম।
বাংলাদেশে কী কী ধরণের বীমা চালু আছে?
বাংলাদেশে সাধারণত দুই ধরনের বীমা (Insurance) হয়–জীবন বীমা এবং সাধারণ বীমা।
(১) জীবন বীমায় (Life insurance) একজন ব্যক্তি নিজের বা পরিবারের কোন সদস্যের জীবন বীমা (Insurance) করাতে পারেন। এতে বীমাকারী ব্যক্তির মৃত্যুর পর বীমাকৃত অর্থের পুরোটাই প্রদান করা হবে তার পরিবার অথবা নমিনি করা ব্যক্তিকে ।
(২) আর সাধারণ বীমার (General insurance) মধ্যে স্বাস্থ্য, শিল্প, কৃষি, বাণিজ্য, যানবাহনসহ যত ধরনের বীমা হয় তার সব কিছুই পড়ে।
বাংলাদেশে মোট ৭৮টি বীমা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, এর মধ্যে ৪৬টি সাধারণ বীমা কোম্পানি এবং ৩২টি জীবন বীমা। এর মধ্যে একটি জীবন বীমা এবং একটি সাধারণ বীমার রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান আছে। এর মধ্যে দুটি বিদেশী বীমা কোম্পানিও আছে রয়েছে।
কী কী বিষয় খেয়াল রাখতে হবে?
অধ্যাপক হাসিনা শেখ বলেন, বাংলাদেশে বীমা প্রতিষ্ঠানগুলোর নেটওয়ার্ক একেবারে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত, ফলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এর কাজ করার সুযোগ অনেক বেশি।
তিনি বলেন, “অ্যাকাউন্ট খোলা, অর্থ জমা করা ও অন্যান্য কাজের জন্য আপনাকে ব্যাংকে যেতে হবে। কিন্তু বীমা করার জন্য ইনস্যুরেন্স এজেন্টরা গ্রাহকের বাড়িতে গিয়ে তাকে বুঝিয়ে রাজি করিয়ে কাজ করান, ফলে কষ্ট বেঁচে যাচ্ছে, আর ব্যাংকে গিয়ে কোন সেবার জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। এজন্য এখন গ্রামের কৃষকও তার কৃষি পণ্য ও গবাদি পশুর জন্য বীমা করেন।”
কিন্তু বীমার মেয়াদ পূর্তির পর অর্থ হাতে পাওয়া নিয়ে অনেক রকম নেতিবাচক অভিজ্ঞতার অভিযোগ শোনা যায়, যে কারণে অধ্যাপক হাসিনা শেখ বলেন, বীমা করার আগেই একজন গ্রাহককে কয়েকটি বিষয় খেয়াল করতে হবে।
- বীমা করার আগে সংশ্লিষ্ট বীমার শর্তাগুলো দেখে, জেনে এবং বুঝে নিতে হবে।
- অর্থ জমা দেয়ার নিয়মাবলী এবং সময়সীমা পার হয়ে গেলে কী করণীয় ভালো করে জেনে নিতে হবে।
- মেয়াদ পূর্তির পর ঠিক কত টাকা এবং কত সময়ের মধ্যে সে প্রতিশ্রুত অর্থ পাওয়া যাবে, তা নিশ্চিতভাবে জেনে নিতে হবে।
- মেয়াদ পূর্তির পর যথাসময়ে প্রতিশ্রুত অর্থ পাওয়া না গেলে গ্রাহকের কী আইনি সুরক্ষা থাকছে সেটা জেনে নিতে হবে।
বীমার অসুবিধা:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক হাসিনা শেখ বলেন, বাংলাদেশে বীমা খাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আস্থার সংকট। বর্তমান যদিও বাংলাদেশে গত ৪৭ বছরের বেশি সময় ধরে বীমা চালু রয়েছে, তা সত্ত্বেও বীমা বিষয়টি নিয়েই সাধারণ মানুষের মধ্যে কিছুটা বিভ্রান্তি এবং পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাব রয়েছে।
একই সঙ্গে মেয়াদ পূর্তির পর কিংবা জীবন বীমার ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যের মৃত্যুর পর বীমাকৃত অর্থ পেতে সমস্যার অভিযোগ শোনা যায়।
“এক্ষেত্রে দুই পক্ষেই সমস্যা হয়, যেমন গ্রাহক হয়তো বীমা করার সময় শর্তসমূহ ঠিকমত খেয়াল করে না। হয়তো কোথাও কোন শর্ত যথাযথভাবে পূরণ হয়নি, কিন্তু সে ক্ষেত্রে গ্রাহককে কী করতে হবে সেটা তিনি জানেন না। আবার অন্যদিকে, গ্রাহককে ঠিকমত পুরো পরিস্থিতি অবহিত করে বীমা করানো কিংবা মেয়াদ শেষে যথাসময়ে প্রতিশ্রুত অর্থ বুঝিয়ে দেয়া–এসব বিষয়ে অনেক সময় কোম্পানির পক্ষ থেকে ঘাটতি দেখা যায়।”
দেশে বীমা এজেন্টদের যথাযথ প্রশিক্ষণ ও দক্ষতার ঘাটতি এর পেছনে একটি কারণ বলে তিনি মনে করেন। “সেই সাথে কোন প্রতিষ্ঠান যদি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে তাহলে সেজন্য শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।”
তথ্যসূত্র: BBC News