নানা ধরনের সবুজ গাছপালা ও মনোমুগ্ধকর পরিবেশে অবসিথত তাজহাট জমিদার বাড়িটি রংপুর সদর থেকে প্রায় ৪ মাইল পূর্ব দক্ষিণে অবসিথত এবং জমিদার বাড়িটির সবচেয়ে ও সহজ চেনার পথ হলে এটি বর্তমান তাজহাট কৃষি ইনস্টিটিউট এর পাশে। জমিদার বাড়ির সামনে রয়েছে বিশাল আকৃতির সোন্দর্যপূর্ণ একটি বাগান ও কৃতিম খননকৃত ৪টি বড় বড় পুকুর। তাজহাট বাজার হতে উত্তর দিক দিয়ে ক্রমান্বয়ে পশ্চিমে পেরিয়ে বর্তমানে জমিদার বাড়িটির প্রবেশ পথে আসা যায়।
তাজহাট জমিদার বাড়িটির স্থানঃ
তাজহাট জমিদার বাড়িটি বাংলাদেশের রংপুর জেলায় রংপুর শহরের মধ্যে তাজহাটে অবস্থিত একটি প্রাচীন মুঘল স্থাপত ঐতিহাসিক প্রাসাদ যা এখন একটি জাদুঘর হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। বর্তমান রংপুরের মধ্যে এটি একটি আকর্ষণীয় স্থান এবং পর্যটকদের কাছে এটি একটি দর্শনীয় স্থান হিসেবে পরিচিত।
তাজহাট জমিদার বাড়ির সংকিপ্ত বর্ণনাঃ
রংপুরের ইতিহাস থেকে জানা যায়, গোবিন্দ লালের পুত্র গোপাল লাল (জি.এল.রায়) এর সাথে সর্ম্পকযুক্ত যা স্থানীয়ভাবে তাজহাট জমিদার বাড়ি হিসেবে পরিচিত। এই জমিদার বাড়িটির পরিমাপ প্রায় চারপাশে ১২৩ ফিট ও ১২০ ফিট লম্বা। উত্তর দক্ষিন অংশে ১২৩ ফিট লম্বা এবং পূর্ব ও পশ্চিম অংশে ১২০ ফিট লম্বা।
দ্বিতীয় তলায় ওঠার জন্য তিনটি প্রশস্ত পথ আছে, যা একটি আকর্ষণীয় এবং চাকচিক্যপূর্ণ পথ। অভিগমন পথের প্রতিটি ধাপ সুন্দর এবং সাদা ও ছাই রংয়ের পাথর দ্বারা মোড়ানো। রংপুর জমিদার বাড়িটির দুপাশে দুটি করে বারান্দা আছে। বারান্দা গুলোর সম্পূর্ণ মেঝে সাদা এবং ছাই রংয়ের মোড়ানো। প্রথম তলার ছাদ নির্মাণে বড় বড় লোহার বীম ও লোহার ফালি ব্যবহার করা হয়েছে। এক তলার ৪টি কক্ষ রয়েছে এবং এতে সর্বমোট ১১টি জোড়া কার্পেট রয়েছে। এ প্রাসাদের প্রকোষ্ঠগুলোতেও ৭টি প্রবেশ দ্বারা সমন্বিত ৩টি বড় বড় কক্ষ এবং পশ্চিম অংশে জোড়া কপাট বিশিষ্ট দরজাসহ বিরাট হলরুম রয়েছে ।
প্রাসাদের উত্তর অংশের মাঝামাঝি ২য় তলায় ওঠানামার জন্য কাঠের তৈরি ২২টি সিঁড়ি রয়েছে। প্রাসাদটির ২য় তলায় ওঠানামার জন্য একটি বিরাট গ্যালারির মতো সিঁড়ি রয়েছে। সিঁড়ি গুলোকে তিনটি স্তরে বিভক্ত করা হয়েছে।প্রথম স্তরে ১টি ধাপ বিরাজমান, ২য় স্তরে একটু সমান আবার ১৪টি ধাপ অতিক্রম করে একটি ছাদে ওঠা যায়, ছাদটি দ্বিতীয় তলার ছাদের সাথে সম্পৃক্ত এবং এই ছাদটি অসাধারণ।বর্তমানে সিঁড়িটির পরিমাপ ৩৩ ফিট প্রশস্ত। প্রাসাদের ভিতর এবং বাইরের সব অংশ সুন্দর মসৃণ সাদা কালো পাথরে মোড়ানো এবং অনেক সুন্দর সুন্দর নকশা করা রয়েছে যা আমাদের পুরানো দিনের রাজবাড়ি বা জমিদার বাড়ির কথা মনে করে দেয়।
তাজহাট জমিদার বাড়ির সংকিপ্ত ইতিহাস –
অনেক আগেই বাংলায় তথা বাংলাদেশে জমিদার প্রথা বা জমিদারিত্ব বিলীন হয়েছে। কিন্তু তাদের রেখে যাওয়া ইতিহাস, ঐতিহ্য ও প্রাচীন স্থাপত্য বাংলার বুকে রয়ে গেছে। উত্তরবঙ্গের তাজহাট জমিদার বাড়ি এর মধ্যে অন্যতম একটি। এই স্থাপনা দেখতে প্রতিদিন দেশ-বিদেশের সর্বস্তরের পর্যটকদের উপস্থিতি দেখা যায়।
প্রাচীন ইতিহাস রংপুরের ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, রত্ন ব্যবসায়ী মান্নালাল রায় তাজহাট জমিদার বাড়ির প্রতিষ্ঠা করেছে। এই বাড়িটি নির্মাণ করতে লেগেছিল প্রায় ১০ বছর। রংপুরের মাহিগঞ্জে এসেছিলেন মান্নালাল রায় ব্যবসার কাজে । তিনি হীরা, জহরত ও স্বর্ণ ব্যবসা করতেন। প্রথমে তিনি নানা ধরণের নামি-দামি হিরা, মানিক, জহরত, তাজ বা টুপির ব্যবসা করতেন। এখানে তাজ বা টুপি বিক্রির লক্ষ্যে হাট বসতো। এই জমিদার বাড়িটির নামকরন করা হয় মূলত তাজহাটকে কেন্দ্র করে। তাজহাট জমিদার বাড়িটি বিশাল জায়গা নিয়ে বিস্তৃত এবং এই বিশাল প্রাসাদটি সম্পূর্ণ সাদা রঙের তৈরি। প্রাচীন মোগল স্থাপত্যের আমলে বানানো জমিদার বাড়িটির মধ্যভাগে বিশাল আকৃতির একটি গম্বুজ রয়েছে। প্রাসাদটির ছড়িয়ে যাওয়া দালানগুলোর একটি মসজিদ আকৃতির। এবং এই প্রাসাদটি চার তলার সমান উঁচু। প্রাসাদে মোট ৩১ টি সিঁড়ি আছে। প্রতিটি সিঁড়ি ইতালীয় ঘরানার মার্বেল পাথরে তৈরি।
সিঁড়ি বেয়ে একটু ওপরে উঠলেই প্রথমে চোখে পড়ে যাবে বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী কক্ষ। যেখানে দেখা যাবে দশম ও একাদশ শতাব্দীর টেরাকোটা শিল্পকর্ম। সংস্কৃত ও আরবি ভাষায় লেখা বেশকিছু প্রাচীন পানডুলিপি রয়েছে এখানে। এর মধ্যে উল্লেখ আছে – মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলের কোরআন, মহাভারত ও রামায়ণের মূল কপি। পিছনের ঘরে কালো পাথর দিয়ে সাজানো হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর প্রতিকৃতি রয়েছে বর্তমানে ছবি তোলার ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে জাদুঘরের ভেতরে ।
প্রাসাদের সামনে সুন্দর ফোয়ারার শ্বেতশুভ্র মার্বেল ও তার সবুজাভ নকশা কালের বিবর্তনে কিছুটা মলিন হলেও এখনও এর জৌলুস আছে। কথিত আছে- রানির জন্য বিশেষভাবে এই প্রাসাদটি নির্মাণ করা হয়েছিল। রাজবাড়ির পেছনের দিকে রয়েছে একটি গুপ্ত সিঁড়ি। জনশ্রুতি রয়েছে, এটি কোনও একটি সুড়ঙ্গের সঙ্গে যুক্ত যা সরাসরি ঘাঘট নদীর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে । এখন যদিও সিঁড়িটি নিরাপত্তাজনিত কারণে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
ঐতিহাসিক তাজহাট জমিদার বাড়িটি ১৯৮৪ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত রংপুর হাইকোর্ট ও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একটি শাখা বা বেঞ্চ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ তাজহাট জমিদার বাড়িকে একটি সংরক্ষিত স্থাপনা তথা স্থাপত্য হিসেবে ১৯৯৫ সালে ঘোষণ করে । ২০০৫ সালে রংপুর জাদুঘরকে সরিয়ে এই প্রাসাদের দোতলায় নিয়ে আসে। বর্তমানে জাদুঘর হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে মিদার বাড়িটি। বর্তমান এই জাদুঘরে নির্দিষ্ট প্রবেশমূল্য দিয়ে প্রবেশ করতে হয়। গাড়ি নিয়ে ঢুকতে চাইলে আলাদা ফি দিতে হয়। এই রাজবাড়িটি আমাদের কাছে একটি ঐতিহাসিক নির্দশন।
কি ভাবে যাবেনঃ
ঢাকা থেকে রংপুর যাওয়ার জন্য বেশ কিছু ভালো পরিবহন রয়েছে। এর মধ্যে গ্রীন লাইন, টি আর ট্রাভেলস, এস এন, নাবিল, হানিফ, এনা, হক, খাজা, ডিপজল,খালেক, জে-কে, এস আর, শ্যামলী, আগমনী ইত্যাদি পরিবহন অন্যতম । ঢাকার আসাদগেট, কল্যাণপুর ,গাবতলী সাভার, গাজিপুর, মিরপুর থেকে প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ছাড়ে এসব বাস। আপনি এসি, ননএসি ও হুন্ডাই বাস পাবেন কাউন্টারগুলো থেকে। এবং আরও একটি ভালো মাধ্যম রয়েছে ঢাকা হতে রংপুর যাওয়ার জন্য সেটি হল ট্রেন। ঢাকার কমলাপুর রেল থেকে প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বিভিন্ন সমেয়ে ছাড়ে এসব ট্রেন (রংপুর এক্সপ্রেস, কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস ও লালমনি এক্সপ্রেস এবং বিশেষ একটি ট্রেন রয়েছে ধর্মীয় সুটিরদিনের জন্য)।
কোথায় থাকবেনঃ
রংপুরে থাকার জন্য বিভিন্ন ধরনের ও মানের নিরাপদ আবাসিক হোটেল ও মোটেল রয়েছে। রংপুরে ভালো হোটেলর মধ্যে রয়েছে হোটেল গোল্ডেন টাওয়ার( (জাহাজ কোম্পানির মোড়), শাহ আমানত (জাহাজ কোম্পানির মোড়), হোটেল ও হোটেল দি পার্ক (জাহাজ কোম্পানির মোড়), হোটেল তিলোত্তমা (থানা রোড), হোটেল বিজয় (জেল রোড), আরডিআরএস (জেল রোড) এবং মোটেল এর মধ্যে অন্যতম রংপুর মোটেল।
টিকেট প্রাপ্তিস্থানঃ
জমিদার বাড়ি জাদুঘরের গেটের পাশেই রয়েছে টিকেট প্রাপ্তির স্থান, জনপ্রতি টিকেট এর দাম ২০ (বিশ) টাকা (২০২০) করে, তবে পাঁচ বছরের কম বাচ্চাদের জন্যে কোনো টিকেটের দরকার পড়েনা। তবে মধ্যম পর্যায়ের শিশু-কিশোরদের জন্য প্রবেশ মুল্যে নির্ধারন করা হয়েছে মাত্র ৫ টাকা। বিদেশি দর্শনার্থীর টিকেট মূল্য ধরা হয়েছে সার্কভুক্তদের জন্য একশত টাকা এবং অন্যান্য বিদেশী দর্শকদের জন্য দুইশত টাকা করে।
বন্ধ-খোলার সময়সূচীঃ
গ্রীষ্মকালে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত জমিদার বাড়ি জাদুঘরটি খোলা পাবেন। তবে দুপুর ১টা থেকে ১.৩০ পর্যন্ত আধ ঘণ্টার জন্যে বন্ধ থাকে। এবং শীতকালে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা পাবেন। শীতকালেও দুপুর ১টা থেকে ১.৩০ পর্যন্ত বন্ধ থাকে। প্রতি শুক্রবারে জুম্মার নামাযের জন্যে ১২.৩০ থেকে ৩টা পর্যন্ত বন্ধ থাকে। রবিবার সাধারণ ছুটি এবং সোমবার বেলা ২.০০টা থেকে খোলা পাবেন। তাছাড়া সরকারী কোন বিশেষ দিবস উপলক্ষে তাজহাট জমিদারবাড়ি জাদুঘর বন্ধ থাকে।
তাজহাট জমিদার বাড়ির সৌন্দর্য লিখে প্রকাশ করা যাবে না। ‘পৃথিবী থেকে অন্য কোথাও এসেছি’ আমার কাছে সামান্য সময়ের জন্য এরকম মনে হয়েছে। আমি আশা করি আপনাদের অনেক ভালো লাগবে। জমিদারবাড়িটি দেখার পর আপনার মন্তব্যটি লিখতে ভুলবেন না। ধন্যবাদ !!